গত বছরের ৫ আগস্টের পর সবচেয়ে লন্ডভন্ড অবস্থা হয়েছিল দেশের পুলিশ বাহিনীর। সারা দেশে থানা লুট, পুলিশ সদস্যদের ওপর আক্রমণ এ বাহিনীকে বিপর্যস্ত এবং বিধ্বস্ত করেছিল। আওয়ামী লীগের পতনের পর বেশ কয়েক দিন দেশ ছিল পুলিশশূন্য। সশস্ত্র বাহিনী জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে নিয়োজিত ছিল। এখনো স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে পারেনি পুলিশ বাহিনী। সরকারের পক্ষ থেকে বলা
হয়েছে, পুলিশ বাহিনীর মনোবল এখনো পুরোপুরি ফিরে আসেনি। কিন্তু মনোবলহারা পুলিশের কিছু সদস্য দুর্নীতিতে মনোযোগ হারায়নি। থানাগুলোতে এখনো দুর্নীতি চলছে। অব্যাহত আছে মামলা এ গ্রেপ্তারবাণিজ্য। গত দেড় বছরে সারা দেশে পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে ১৩২৮টি দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ১৭৮ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে পুলিশের ঘুষ ও দুর্নীতির চিত্র কোনো নতুন বিষয় নয়। তবে সাম্প্রতিক তথ্য-উপাত্তে এটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, নানা প্রতিশ্রুতি, উচ্চপর্যায়ের ঘোষণা এবং সীমিত সংস্কার প্রচেষ্টার পরও পুলিশের ভিতরের দুর্নীতির জাল ছিঁড়তে পারছে না সরকার। বরং এ দুর্নীতি আরও কাঠামোগত রূপ নিয়েছে, যা জনগণের ন্যায়বিচার পাওয়ার আশাকে প্রতিনিয়ত বিপন্ন করে তুলছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায়, পুলিশ বিভাগের সেবা পেতে গিয়ে ঘুষ দিতে হয়েছে এমন ভুক্তভোগীর হার প্রায় ৬২ শতাংশ। অর্থাৎ, পুলিশের সেবা এখনো সুলভ নয়, বরং তা একপ্রকার ‘মূল্য দিয়ে কেনা সুবিধা’ হয়ে উঠেছে। অপরদিকে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের জরিপে বলা হয়েছে, পুলিশের সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির মুখোমুখি হয়েছেন এমন মানুষের হার ৭৪.৫ শতাংশ। ঘুষ দিয়েছেন ৫৮ শতাংশ। এমন বাস্তবতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে পড়ছে।
পুলিশের অভ্যন্তরে ঘুষের যে রকম প্রকৃতি ও নকশা তৈরি হয়েছে, তা কেবল ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একপ্রকার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। নিয়োগ ও বদলিবাণিজ্য, মামলা ব্যবসা, অপরাধীদের সঙ্গে আঁতাত, রিমান্ডে নির্যাতনের মাধ্যমে অর্থ আদায়, রাস্তায় চাঁদাবাজি, এসব দুর্নীতির ধরন নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠেছে। পুলিশ সংস্কার কমিশন ইতোমধ্যে এসব দুর্নীতির অন্তত নয়টি ধরন চিহ্নিত করেছে, কিন্তু এখনো কার্যকর কোনো শাস্তির দৃষ্টান্ত জনগণ দেখতে পায়নি।
সড়ক-মহাসড়কে পুলিশের চাঁদাবাজি একটি দৃশ্যমান দুর্নীতি। পরিবহন খাতে এ চাঁদাবাজির টাকা ছাপানো সিøপ বা কাগজ দিয়ে তোলা হয়। ফুটপাত ব্যবসা বা ইনফরমাল সেক্টর পুলিশের দুর্নীতির অন্যতম একটি খাত। বিশেষত ঢাকা-চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় ফুটপাত দখল করে বসানো অবৈধ অস্থায়ী দোকানপাট থেকে পুলিশ দৈনিক দোকানপ্রতি ভাড়া আদায় করে। বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের মতে, বছরে এই চাঁদার পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পুলিশের ঘুষ-দুর্নীতি সম্পর্কে বলেন, পুলিশের কোনো পরিবর্তনই হয়নি! আগে যে ব্যবসায়ীকে ১ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হতো, সে এখন বাধ্য হয়ে ৫ লাখ টাকা ঘুষ দিচ্ছে। এটাই সত্য, এটাই বাস্তবতা। পুলিশের কোনো পরিবর্তনই হয়নি বরং আরও হয়রানি করছে। একবার বলছে অমুকের কাছে যাও, একবার বলছে কোর্টে যাও, এভাবে তারা দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
দুর্নীতির অন্যতম কারণ হিসেবে পুলিশ বাহিনীর অপর্যাপ্ত বাজেট ও স্বচ্ছ নজরদারির অভাবকে চিহ্নিত করা হচ্ছে। অনেক থানায় সরকার নির্ধারিত অনুদান অপর্যাপ্ত হওয়ায় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজের খরচে অনেক কাজ চালান এবং পরে তা আদায় করেন ঘুষের মাধ্যমে। এ ছাড়া রাজনৈতিক প্রভাব, জবাবদিহির অভাব ও শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ অডিট ব্যবস্থার অনুপস্থিতিও এ দুর্নীতিকে উৎসাহিত করছে।
সরকারের পক্ষ থেকে ডিজিটাল জিডি, অনলাইন অভিযোগ দাখিল, থানার সেবামূল্য তালিকা প্রদর্শন, নিরপেক্ষ তদন্তব্যবস্থার কথা বলা হলেও অনেক ক্ষেত্রেই এগুলো নামমাত্র বাস্তবায়িত হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুলিশে সংস্কার বিষয়ে একাধিক পরিকল্পনা ঘোষণা করলেও সেগুলোর ফল আজও দৃশ্যমান নয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ বাস্তবতায় সরকারকে শুধু প্রতিশ্রুতি দিয়ে থেমে থাকলে চলবে না। প্রয়োজন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, নিরপেক্ষ তদন্ত এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলা, যেখানে সেবা হবে অধিকার, ঘুষ নয়। পুলিশের ঘুষ ও দুর্নীতিকে যদি কঠোরভাবে রোধ না করা যায়, তবে দেশের আইনের শাসন কেবল মুখের কথা হয়েই থাকবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন। দুর্নীতি বন্ধের জন্য লটারির মাধ্যমে ৬৪ জেলার এসপি পদায়ন হয়েছে। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনের জন্য ৬৪ জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) চূড়ান্ত করেছে অন্তর্র্বর্তী সরকার।
গত ২৪ নভেম্বর সোমবার প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় লটারি করে এই এসপিদের নির্বাচন করা হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদরদপ্তরের একাধিক সূত্র জানায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তাদের বদলি-পদায়নের লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ অনুযায়ী যোগ্য কর্মকর্তাদের তালিকা সংশ্লিষ্ট কমিটির হাতে দেওয়া হয়। লটারির মাধ্যমে জেলাওয়ারি পদায়ন চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। এ কারণে গত সপ্তাহে ৬ জেলায় দেওয়া নতুন এসপি নিয়োগের যোগদান স্থগিত রাখা হয়। এখন এ ক্ষেত্রে লটারির সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। পুলিশের রেঞ্জ উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি), জেলার পুলিশ সুপার ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) রদবদল নিয়ে গত ২২ নভেম্বর বৈঠক করেন কয়েকজন উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এসপি পদায়নের পরের ধাপে থানার ওসি নিয়োগও লটারির ভিত্তিতে করা হবে বলে সূত্র জানায়। সৎ, নিরপেক্ষ ও যোগ্য পরিদর্শকদের তালিকা এরই মধ্যে ইউনিটপ্রধানদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
পুলিশ সদরদপ্তরের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, নির্বাচনকেন্দ্রিক পুলিশিং নিয়ে কোনো ধরনের বিতর্ক এড়াতে লটারির পদ্ধতি নেওয়া হয়েছে। এতে মাঠপর্যায়ে নিরপেক্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ নিশ্চিত হবে।
সংশিষ্ট মহল মনে করেন, এটি পুলিশে দুর্নীতি বন্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কিন্তু পুলিশে দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে নীতি কাঠামোর পরিবর্তন প্রয়োজন।