রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন দ্রুত জনসম্মুখে প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন নিহত সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যরা। একই সঙ্গে জড়িত কেউ যাতে বিচার থেকে রেহাই না পায় সে বিষয়ে সরকারের কঠোর ভূমিকা কামনা করেছেন তারা। স্বজনদের অভিযোগ, তাঁরা সাক্ষ্য দিতে গিয়ে নানামুখী সামাজিক ও অনলাইন হয়রানির শিকার হয়েছেন। এখনো তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
গতকাল রাজধানীর রাওয়া ক্লাবে ‘বিডিআর তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশে শহীদ পরিবারের মতপ্রকাশ’ শিরোনামে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের স্বজনেরা এসব কথা বলেছেন। টানা ১১ মাস পরিশ্রম করে রিপোর্ট প্রকাশ করায় কমিশনকে ধন্যবাদ জানান নিহতের স্বজনরা। তবে রিপোর্ট প্রকাশে কিছু কিছু নাম প্রকাশ না করায় ক্ষোভও জানান তারা। এর আগে রবিবার জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন বিডিআর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেয়। পরে সন্ধ্যায় কমিশন আংশিক তথ্য প্রকাশ করে। সেখানে আলোচনায় আসে ঘটনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তির নাম ও আন্তর্জাতিক সংশ্লিষ্টতার ইঙ্গিত।
সংবাদ সম্মেলনে পিলখানায় নিহত লে. কর্নেল লুৎফর রহমান খানের মেয়ে ডা. ফাবলিহা বুশরা বলেন, কমিশনের প্রধান জেনারেল ফজলুর রহমান বলেছেন, প্রতিবেদনটি ‘ক্ল্যাসিফায়েড’ নয় এবং পরে জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। শহীদ পরিবারের আহ্বান, প্রক্রিয়াটিতে বিলম্ব না করে দ্রুত বিচার বিভাগে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের জন্য পাঠানো, সম্ভাব্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা, যেমন ট্রাভেল ব্যান নিশ্চিত করা এবং তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা।
ফাবলিহা বুশরা আরও বলেন, ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনের প্রাণহানি শুধুই একটি পরিবারের ট্র্যাজেডি নয়, এটি জাতিগত বিপর্যয়। করদাতাদের অর্থে সংগঠিত রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করে সার্বভৌমত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করার যে ষড়যন্ত্র ঘটেছে, তার সত্য জানার অধিকার দেশের প্রতিটি নাগরিকের আছে।
পিলখানায় হত্যার শিকার কর্নেল কুদরত ইলাহীর সন্তান আইনজীবী সাকিব রহমান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘কমিশন খুব স্পষ্টভাবে বলেছেন, কিছু কিছু নাম, যেগুলো তাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা এই মুহূর্তে সেগুলো প্রকাশ করতে পারবেন না। সেটার যৌক্তিকতাটা আমরা কিছুটা বুঝি। তবে আমার মনে হয় না যে এটাকে অজুহাত দেখিয়ে অনেক দিন ধরে সেই নাম প্রকাশ হবে না। সেটা কোনোভাবে আমরা মেনে নেব না।’
তিনি আরও বলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব সামরিক ও বেসামরিক সবার বিরুদ্ধে যেন অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট জারি করা হয় এবং তারা যেন অ্যারেস্ট হয়। যদি রিপোর্টটা পাবলিক না হয়, আমরা আশঙ্কা করি, যেসব মানুষের নাম এসেছে, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে।’ শেখ হাসিনা ভারতের স্বার্থে আর নিজের ক্ষমতার স্বার্থে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়ন করেছেন বলে উল্লেখ করেন পিলখানায় হত্যার শিকার বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের ছেলে রাকিন আহমেদ ভূঁইয়া। তিনি বলেন, মীর জাফরদের বিচার করা না হলে কিন্তু ভবিষ্যতে আরেকটা পিলখানা হত্যাকাণ্ড করার সুযোগ রয়েছে।
পিলখানায় হত্যার শিকার কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর নুরুল ইসলামের ছেলে আশরাফুল আলম হান্নান বলেন, ‘এই রিপোর্টের পর আমরা শুধু শহীদ পরিবার নয়, এ দেশের সব জনগণ এখন একেবারে সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারবে যে এই হত্যাকাণ্ড কারা ঘটিয়েছে। এটা আমাদের এ সময়ের জন্য সবচেয়ে বড় অর্জন। এ দেশের মানুষ একেবারে সুনির্দিষ্ট করে বলবে যে আওয়ামী লীগ এই হত্যাকাণ্ড করেছে। শেখ হাসিনা এই হত্যাকাণ্ড করেছে। ভারত এর সঙ্গে জড়িত ছিল। এখন আমাদের আর কোনো ভীতিতে থাকতে হবে না। আর আমি সরকারের কাছে দাবি করব, এই যে রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে, এটি যেন দ্রুত সময়ে ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়।’
শহীদ মেজর কাজী মোসাদ্দেক হোসেনের মেয়ে কাজী নাজিয়া তাবাসসুম বলেন, ‘দীর্ঘ ১৬ বছর হত্যার শিকার সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারগুলো অবহেলা, ভান করা সহমর্মিতা আর মিথ্যা আশ্বাসই পেয়েছে। এখনো পরিবারগুলো পুরো আস্থা পায় না, কারা সত্যিকার অর্থে তাদের পাশে আছে।’ হত্যার শিকার কর্নেল মুজিবুল হকের ছেলে মুহিব হক বলেন, ‘ডিফেমেশন শুধু আইনি শব্দ না, এটা একটা অস্ত্র। এই অস্ত্রটা ব্যবহার করা হয়েছে আমাদের পরিবারের বিরুদ্ধে, দেশের বিরুদ্ধে, ন্যায়বিচারের বিরুদ্ধে।’
সাংবাদিক সম্মেলনে পরিবারগুলো গত এক বছরে তদন্ত কমিটির কাছে দেওয়া সাক্ষ্যের কথা তুলে ধরেন। জানান ঘটনার পর থেকেই তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাই শহীদ পরিবারদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার দাবি পুনর্ব্যক্ত করেন। একই সঙ্গে বিডিআর হত্যাকাণ্ডকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার না করার আহ্বান জানান তারা।