প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বিগত সরকারের আমলে সশস্ত্র বাহিনীর যেসব সদস্য অন্যায়ভাবে বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, অন্য সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মতো তাদেরও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে সরকার।
গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বিগত সরকারের আমলে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর চাকরিতে বৈষম্য, বঞ্চনা, অবিচার ও প্রতিহিংসার শিকার হওয়া অবসরপ্রাপ্ত ও বরখাস্ত কর্মকর্তাদের আবেদন পর্যালোচনা করে সুপারিশ পেশের জন্য গঠিত কমিটি প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন হস্তান্তরের পর এই মন্তব্য করেন তিনি। এ সময় উপস্থিত ছিলেন কমিটির সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টার প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়নবিষয়ক বিশেষ সহকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবদুল হাফিজ (অব.), কমিটির সদস্য মেজর জেনারেল মুহম্মদ শামস-উল-হুদা (অব.), মেজর জেনারেল শেখ পাশা হাবিব উদ্দিন (অব.), রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ শফিউল আজম (অব.) এবং এয়ার ভাইস মার্শাল মুহাম্মদ শাফকাত আলী (অব.)। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এ তথ্য জানিয়েছে।
তদন্ত কমিটির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, প্রথমে মনে হয়েছিল সামান্য কিছু অনিয়ম হয়তো হয়েছে; কিন্তু আপনারা যে পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে এনেছেন তা রীতিমতো ভয়াবহ। পূর্ণ পেশাদারিত্ব ও নির্মোহ থেকে সত্য বের করে আনায় কমিটির সব সদস্যকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
আবদুল হাফিজ জানান, স্ব স্ব বাহিনী কর্তৃক গঠিত বোর্ড যাদের বিষয়ে সুপারিশ প্রদান করেছে তাদের বিরুদ্ধে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো নৈতিক স্খলনজনিত শাস্তি কিংবা অভিযোগ নথিভুক্ত ছিল না। ভুক্তভোগী অফিসারদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের অধিনায়ক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের বঞ্চনা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে কমিটি। ৭৩৩টি আবেদন যাচাইবাছাই করে ১৪৫টির ব্যাপারে বিভিন্ন সুপারিশ করেছে কমিটি। এর মধ্যে সেনাবাহিনীতে বৈষম্যের শিকার ১১৪, নৌবাহিনীতে ১৯ ও বিমানবাহিনীতে ১২ কর্মকর্তাকে (যার জন্য যা প্রযোজ্য) স্বাভাবিক অবসর প্রদান, পদোন্নতি, অবসর-পূর্ব পদোন্নতি, বকেয়া বেতন ও ভাতা এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি প্রদান করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর চারজনকে চাকরিতে পুনঃবহালের সুপারিশ করেছে কমিটি। কমিটির অনুসন্ধানে জানা যায়, আবেদনকারীদের মধ্যে ছয় কর্মকর্তাকে তাদের আত্মীয়-স্বজনের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার দরুন বা জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অপবাদ দিয়ে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে বিভিন্ন মেয়াদে (এক বছর থেকে আট বছর পর্যন্ত) গুম করে রাখা হয়। একজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসারকে জঙ্গি নাটক সাজিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে ওই অফিসারের স্ত্রীকে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে এক বছরের শিশুসহ বিনা বিচারে দুই দফায় দীর্ঘ ছয় বছর কারাগারে রাখা হয়। কিছু অফিসার বিডিআর হত্যাযজ্ঞের নারকীয় ঘটনায় সরকারের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে সোচ্চার থাকায় তাদের মধ্যে পাঁচজনকে একটি ভুয়া ঘটনা (ব্যারিস্টার তাপস হত্যাচেষ্টা মামলা) সাজিয়ে ব্যাপক নির্যাতন করা হয়।
চারজন কনিষ্ঠ অফিসার (লেফটেন্যান্ট পদবির) ধর্মীয় আচার-আচরণ নিয়ম-নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করার কারণে তাদের কোনো একটি দলের অনুসারী হিসেবে অথবা জঙ্গি ট্যাগ দিয়ে অন্যায়ভাবে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। পাঁচজন অফিসার ১/১১ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ডিজিএফআইতে কর্মরত থাকাকালীন তাদের মিথ্যা অভিযোগে কিংবা বিনা অভিযোগে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এ ছাড়া কিছু কর্মকর্তা বিডিআর হত্যাযজ্ঞের পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর দরবারে প্রশ্ন করার জন্য সেনাসদর কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। একপর্যায়ে ওই দরবারে ব্যাপক হট্টগোল হওয়ায় পাঁচজন অফিসারকে অযথা দায়ী করে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই তাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।