রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্পে প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির তিন মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সাত বছর করে মোট ২১ বছরের কারাদণ্ড এবং ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড ও ১ লাখ টাকা করে অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। এদিকে মামলায় শেখ হাসিনার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন দুদকের প্রসিকিউটররা।
গতকাল ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে শেখ হাসিনাকে তিন মামলায় কারাদণ্ড ছাড়াও ১ লাখ টাকা করে মোট ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। অনাদায়ে ছয় বছর করে মোট ১৮ বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ভিন্ন মামলায় সজীব ওয়াজেদ জয়কে পাঁচ বছর কারাদণ্ডের পাশাপাশি ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে, অনাদায়ে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আরেক মামলায় সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড করা হয়, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া একজন আসামিকে খালাস দিয়ে বাকি ১৮ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে। রায় ঘোষণার সময় একমাত্র আসামি হিসেবে খুরশীদ আলম উপস্থিত ছিলেন। রায় শেষে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। বাকি আসামিরা পলাতক থাকায় আদালত তাদের বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানাসহ গ্রেপ্তারি আদেশ জারি করেছেন।
অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম সরকারকে খালাস দিয়েছেন আদালত। সাজাপ্রাপ্ত অন্যরা হলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক একান্ত সচিব মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিনকে ২ মামলায় ছয় বছর করে মোট ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড ও অনাদায়ে ছয় মাস করে এক বছরের কারাদণ্ড; সাবেক প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদকে ৩ মামলায় ৬ বছর করে মোট ১৮ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকারকে ৩ মামলায় ৬ বছর করে মোট ১৮ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১ লাখ টাকা করে মোট ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ৬ মাস করে দেড় বছরের কারাদণ্ড; গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) কাজী ওয়াছি উদ্দিনকে ৩ মামলায় ৬ বছর করে মোট ১৮ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১ লাখ টাকা করে মোট ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ৬ মাস করে দেড় বছরের কারাদণ্ড; সাবেক সিনিয়র সহকারী সচিব পূরবী গোলদারকে ৩ মামলায় ১ বছর করে মোট ৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ৩ মাস কারাদণ্ড; রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞাকে ৩ মামলায় ৫ বছর করে মোট ১৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা করে মোট দেড় লাখ টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ৯ মাসের কারাদণ্ড; রাজউকের সাবেক সদস্য (পরিকল্পনা) মোহাম্মদ নাসির উদ্দীনকে ৩ মামলায় ৩ বছর করে মোট ৯ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ৬০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ৬ মাস কারাদণ্ড; মেজর (ইঞ্জিনিয়ার) সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী (অব.) কে ৩ মামলায় ৩ বছর করে মোট ৯ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ৬০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ৬ মাস কারাদণ্ড; রাজউকের সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) কবির আল আসাদকে ১ মামলায় ৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ২ মাসের কারাদণ্ড; রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ) তন্ময় দাসকে ২ মামলায় ৩ বছর করে মোট ৬ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ৪০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ৪ মাস কারাদণ্ড; রাজউকের সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মো. নুরুল ইসলামকে ২ মামলায় ৩ বছর করে মোট ৬ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ৪০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ৪ মাসের কারাদণ্ড; রাজউকের পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-২) শেখ শাহিনুল ইসলামকে এক মামলায় ৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ২ মাসের কারাদণ্ড; রাজউকের পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-২) মো. কামরুল ইসলামকে এক মামলায় ৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ২ মাসের কারাদণ্ড; রাজউকের সহকারী পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-৩) মো. হাফিজুর রহমানকে এক মামলায় ১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ১ মাসের কারাদণ্ড; রাজউকের সহকারী পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-৩) মো. হাবিবুর রহমান সবুজকে এক মামলায় ১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ১ মাসের কারাদণ্ড; রাজউকের সহকারী পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-৩) নায়েব আলী শরীফকে ২ মামলায় ১ বছর করে মোট ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ২ মাসের কারাদণ্ড; রাজউকের সহকারী পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-৩) মাজহারুল ইসলামকে এক মামলায় ১ বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ১ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। আসামিদের মধ্যে একমাত্র গ্রেপ্তার থাকা রাজউকের সাবেক সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মোহাম্মদ খুরশীদ আলমকে ৩ মামলায় ১ বছর করে মোট ৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ৩ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে। রায়ের পর দুদকের কৌঁসুলি খান মো. মাইনুল হাসান লিপন বলেন, আমরা সর্বোচ্চ সাজা প্রত্যাশা করেছিলাম, তা হয়নি। কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এর আগে প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগে গত জানুয়ারিতে পৃথক ৬ মামলা করে দুদক। এরপর ৩১ জুলাই শেখ হাসিনাসহ এই তিন মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু হয়। এসব মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, সরকারের সর্বোচ্চ পদে থাকাকালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের ওপর অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। তারা বরাদ্দ পাওয়ার যোগ্য না হওয়া সত্ত্বেও অসৎ উদ্দেশ্যে পূর্বাচল আবাসন প্রকল্পের ২৭ নম্বর সেক্টরের ২০৩ নম্বর রাস্তার ৬টি প্লট শেখ হাসিনাসহ তার পরিবারের সদস্যদের নামে বরাদ্দ নেন। জয় ও পুতুলের বিরুদ্ধে যে অভিযোগে বলা হয়, রাজউকের এখতিয়ারাধীন এলাকায় বাড়ি বা ফ্ল্যাট বা আবাসন সুবিধা থাকার পরও তা হলফনামায় গোপন করে পূর্বাচল নতুন শহর আবাসন প্রকল্পে আইন লঙ্ঘন করে মাকে অবৈধভাবে প্রভাবিত করে ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নেন। পুতুলের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ করা হয়। ছয় মামলার মধ্যে তিন মামলায় গতকাল রায় হয়েছে। বাকি তিন মামলায় শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা, মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিক এবং ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিসহ অন্যরা আসামি রয়েছেন। সব মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়া।