৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে নতুন এক ধরনের চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে। তা হলো ‘ফ্যাসিস্টদের দোসর’ ট্যাগ দিয়ে চাঁদাবাজি। সুযোগসন্ধানী কিছু মানুষের এখন অন্যতম আয়ের পথ হচ্ছে এভাবে চাঁদাবাজি। সরকারি কর্মকর্তা, বেসরকারি চাকরিজীবী, শিক্ষক, ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন পেশাজীবীকে টার্গেট করা হচ্ছে এ ধরনের চাঁদাবাজির জন্য। বলা হচ্ছে, আপনি সাবেক সরকারের সুবিধাভোগী। বিগত সরকারের আমলে আপনি অনেক সুবিধা পেয়েছেন, এখন চাঁদা দিন, না হলে হত্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হবে। গত এক বছরে এ ধরনের চাঁদাবাজি বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে।
ব্যবসায়িক পাওনা ৬ কোটি টাকা। সেই পাওনা না দিয়ে উল্টো পাওনাদারের নামে চাঁদাবাজির মামলা দেন দেনাদার। জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের ওই নেতার দায়ের করা মামলার এজাহারে তাঁকে ‘ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর’ উল্লেখ করা হয়েছে। মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিটি হচ্ছেন এস এস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সাদেক।
২ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে মোহাম্মদপুরের নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন আবু সাদেক। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ‘চাঁদা আদায়ের চেষ্টা’। সঙ্গে ট্যাগ জুড়ে দেওয়া হয়েছে তিনি ‘ডিবি হারুন সিন্ডিকেটের সদস্য’ আর ‘ফ্যাসিস্টদের দোসর’।
তবে প্রাথমিকভাবে কোনো অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ এবং গ্রেপ্তার অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। তিন দিনের মধ্যে ওই ব্যবসায়ীকে জামিন দেন নিম্ন আদালত। চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি ঢাকার আদালতে জুলফিকার মল্লিক নামে আরেক ব্যবসায়ী মামলাটি দায়ের করেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, চাঁদাবাজির উদ্দেশ্যে ২০২৩ সালে মোট তিনবার জুলফিকার মল্লিককে তুলে নিয়ে ডিবি পুলিশের প্রধান হারুন অর রশীদের মিন্টো রোডের দপ্তরে নেওয়া হয়। সেখানে বিভিন্নভাবে তাঁকে ভয়ভীতি দেখানো হয়। পরে এজাহারে চাঁদা দাবির পরিমাণ প্রায় ৬ কোটি টাকা উল্লেখ করা হয়।
তবে ডিবি কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে জানা যায়, ডিবির মূল গেট দিয়ে প্রবেশের পর অভ্যর্থনাকক্ষে একটি লগখাতা পূরণ করতে হয় প্রত্যেক প্রবেশকারীকে। সেখানে নাম, বাসার ঠিকানা, ফোন নম্বর, কোন অফিসারের কক্ষে যাবেন সেই তথ্য উল্লেখ করতে হয়। কেউ যদি গাড়িতে আসেন, তাকেও গাড়ি থেকে নেমে তথ্যগুলো দিতে হয়। তবে ২০২৩ সালের ১৩ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি ডিবির লগখাতায় জুলফিকার মল্লিক নামে কারও প্রবেশের তথ্য পাওয়া যায়নি।
এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, আসামি সাদেক ২১ ফেব্রুয়ারি জুলফিকারকে ফোনে হুমকি দিয়ে ডিবি অফিসে যেতে বলেন এবং তিনি বেলা সাড়ে ১১টায় ডিবিতে প্রবেশ করেন। অথচ ডিবি জানায়, ওইদিন লগখাতায় জুলফিকারের প্রবেশের তথ্য পাওয়া যায়নি। শুধু তাই নয়, ২০২৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ডিবিপ্রধান হারুন নিজ কার্যালয়ে নয়, বরং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। মামলাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কাগজপত্র যাচাই করে জানা যায়, ব্যবসায়িক পাওনার ৬ কোটি টাকা ফেরত না দেওয়ার কৌশল হিসেবে সাদেকের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়েছে।
গত ১৯ মে রাত ১১টার পর ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যা দিয়ে হাক্কানী পাবলিশার্সের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফার বাসা ঘেরাও করে উত্তেজিত জনতা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা। এরপর বাসার দারোয়ানকে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করে তারা। ৯৯৯-এ কল করে পরিস্থিতি জানিয়ে অভিযোগ করার পর ঘটনাস্থলে আসে পুলিশ। গোলাম মোস্তফাকে গ্রেপ্তারে চাপ ও পুলিশের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় জড়িয়েও পড়ে উপস্থিত কয়েকজন। এ ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মোহাম্মদপুর থানার সমন্বয়ক রাব্বিসহ কয়েকজনকে হেফাজতে নেয় ধানমন্ডি থানা পুলিশ। পরদিন ধানমন্ডি থানায় উপস্থিত হয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতা হান্নান মাসউদ মুচলেকা দিয়ে তাদের ছাড়িয়ে আনেন। এদের মূল উদ্দেশ্য ছিল চাঁদাবাজি। এজন্যই ফ্যাসিস্ট ট্যাগ দিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়।
এ একই চক্র ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় সমন্বয়ক পরিচয়ে ‘সেফ হাসপাতাল’ নামক একটি হাসপাতালে শিশুর মৃত্যু নিয়ে চাঁদা দাবি করে। তারা কয়েকজন এসে হাসপাতালের মালিকের কাছে চাঁদা চেয়ে মব তৈরি করে। হাসপাতালের মালিক সেনাবাহিনীকে ফোন করলে তারা এসে চারজনকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়।
এ ঘটনায় মামলার বাদী শিল্পী আক্তার জানান, ‘আমার হাসপাতালে একটি মৃত শিশু জন্ম নেওয়া কেন্দ্র করে রবিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় কয়েকজন গিয়ে আমাকে চাঁদা চেয়ে হুমকি দেয়। কয়েক দফায় তারা আমার এবং আমার ছেলের কাছে চাঁদা দাবি করে। আমি তাদের চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তারা আরও কয়েকজন সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে আমার প্রতিষ্ঠানে যায়। এমন অবস্থা দেখে সেনাবাহিনীকে ফোন করলে তারা ঘটনাস্থলে এসে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে চারজনকে থানায় নিয়ে যায়। আমি থানায় গিয়ে তাদের বিরুদ্ধে একটি চাঁদাবাজি মামলা করেছি।’
এভাবেই বিভিন্ন জায়গায় চলছে চাঁদাবাজি। চাঁদা না দিলে ভুয়া মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। চাঁদাবাজদের কাছে অসহায় মানুষ।