সুন্দরবনকে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর দস্যুমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে বনদস্যুরা। অন্তত ২০টি বনদস্যু বাহিনী এখন সক্রিয়। তারা জেলেদের অপহরণ করে আদায় করছে লাখ লাখ টাকা মুক্তিপণ। এতে অশান্ত হয়ে উঠেছে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট সুন্দরবন। জেলে, বনজীবীদের মাঝে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। বনসংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৮ সালে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণার পর প্রায় ছয় বছর জেলে-বনজীবীরা ছিলেন নির্বিঘ্ন। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর পাল্টে যেতে থাকে পরিস্থিতি। বন বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, জেলে ও ব্যবসায়ী সূত্রে জানা গেছে, বনদস্যুরা বিভিন্ন নামে দল (বাহিনী) গঠন করে অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে জাহাঙ্গীর বাহিনী, মানজুর বাহিনী এবং দাদাভাই বাহিনী অস্ত্র ও সদস্যসংখ্যায় বেশি এবং দুর্ধর্ষ। এ ছাড়া করিম শরীফ বাহিনী, আসাবুর বাহিনী, দয়াল বাহিনী, রবি বাহিনী, দুলাই ভাই বাহিনী, রাঙ্গা বাহিনী, সুমন বাহিনী, আনারুল বহিনী, হান্নান বাহিনী ও আলিফ বাহিনীর নাম উল্লেখযোগ্য। এর বাইরেও আরও সাত-আটটি দস্যুবাহিনী রয়েছে। এদের একেক বাহিনীতে ২০ থেকে ৪০ জন পর্যন্ত সদস্য রয়েছে। তাদের রয়েছে দেশিবিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র। এরা গহিন বনে আস্তানা গড়ে জেলেদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে। এক বছরে ৩ শতাধিক জেলে অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে দস্যুদের পদচারণ বেশি। বনের মরাভোলা, আলীবান্দা, ধনচেবাড়িয়া, দুধমুখী, শ্যালা, নারকেলবাড়িয়া, তেঁতুলবাড়িয়া, টিয়ার চর, পশুর, আন্ধারমানিক, শিবসাসহ বিভিন্ন এলাকায় বাহিনীগুলোর অবস্থান।
পরিবেশবাদী সংগঠন সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম ও সুন্দরবন রক্ষায় আমরা সংগঠনের প্রধান সমন্বয়কারী মো. নূর আলম শেখ জানান, লোকালয়ে বসবাস করে বনদস্যু বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করে গডফাদাররা। তাদের রয়েছে নিজস্ব সোর্স। বনদস্যু ও গডফাদারদের দমন করতে না পারলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস এবং জীবনজীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করা উচিত।
মোংলা কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার আবরার হাসান বলেন, ‘বনদস্যু দমনে নিয়মিত অভিযানের পাশাপাশি বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে। ৩ অক্টোবর পর্যন্ত এক বছরে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় ২৭টি অভিযানে ৪৪ বনদস্যু ও তাদের সহযোগী আটক করেছে কোস্টগার্ড। জিম্মি থাকা ৪৮ জেলেকে নিরাপদে উদ্ধার করা হয়েছে।’
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগ বাগেরহাটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. রেজাউল করীম চৌধুরী বলেন, ‘বনরক্ষীদের টহল জোরদার করা হয়েছে।’
এদিকে আবার অপরাধজগতে ফেরা অনেকেই বলছেন, ক্ষোভ ও হতাশায় বাধ্য হয়ে তারা এ কর্মে ফিরেছেন। সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন আত্মসমর্পণ করা জাহাঙ্গীর বাহিনীর প্রধান জাহাঙ্গীর শেখ, দাদা ভাই বাহিনী প্রধান জয়নাল আবেদীন ওরফে রাজন এবং মানজুর বাহিনীর প্রধান মানজুর সরদার। তাঁরা বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর তাঁরা সরকারি সহায়তা থেকে অনেকটা বঞ্চিত। বয়ে বেড়াতে হচ্ছে দস্যু নামের পুরোনো অপবাদ। সাবেক দস্যু নাম শুনলেই কেউ তাদের কাজে নেয় না। অন্য এলাকায় অপরাধ সংঘটিত হলে সেখানে তাঁদের সম্পৃক্ততা দেখিয়ে মিথ্যা মামলা এবং প্রশাসনিক হয়রানি করা হয়। সামাজিক মর্যাদা, নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা পেলে আবারও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবেন তাঁরা।