কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো। ফলে উখিয়া ও টেকনাফের বিশাল রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে কমে আসছে আর্থিক সহায়তা। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর অনুদান উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ায় খাদ্য, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য মৌলিক সেবা প্রদানে মারাত্মক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে রোহিঙ্গাদের দৈনন্দিন জীবনে। ফলে মাদক চোরাচালান ও অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে। রোহিঙ্গা শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবসন কমিশনার (আরআরআরসি) অতিরিক্ত সচিব মিজানুর রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যাওয়ায় রোহিঙ্গাদের পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। তাদের ক্যাম্পের বাইরে কাজ খুঁজতে যাওয়ার প্রবণতা বাড়বে। যা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গা সংকটের কোনো টেকসই সমাধান নেই। দাতা দেশগুলোর সহায়তা কমে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা যুবক সাইফুল্লাহ, কলিম উল্লাহ, বাহাদুর বলেন, ‘আগে মাসে চাল, ডাল, তেল, কাপড় সবই আসত। এখন কুপন কেটে দিয়েছে। অনেক সময় ওষুধও পাওয়া যায় না। আমরা তো কোনো কাজ করতে পারি না। বাজার থেকে কিনে খাওয়ারও উপায় নেই। যদি এ সাহায্যও বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে আমরা না খেয়ে মরব।’
সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গা ঢলের পর আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বড় পরিসরে আর্থিক সহায়তা শুরু করে। সংস্থাগুলোর সহায়তার কারণে ২০১৮ সালে চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ পূরণ করত সংস্থাগুলো। কিন্তু ২০২০ সালের পর থেকে ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে আন্তর্জাতিক আর্থিক সহযোগিতা। কমতে কমতে ২০২৫ সালে তা নেমে এসেছে মাত্র ৪০ থেকে ৫০ শতাংশে। একইভাবে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) চালের কুপন কমিয়েছে। অনেক স্বাস্থ্য প্রকল্প ও শিক্ষা প্রকল্প বন্ধ হওয়ার পথে। ২০১৮ সালে রোহিঙ্গাদের ৫০ কেজি চাল, ৩-৪ কেজি ডাল, তেল, শাকসবজি, প্রয়োজনীয় কাপড় দেওয়া হতো। বর্তমানে তা কমিয়ে চাল করা হয়েছে ৩০ কেজি। অর্ধেক করা হয়েছে ডাল ও তেল। সীমিত করা হয়েছে শিক্ষা ও চিকিৎসা সহায়তা।
জানা যায়, ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে বাংলাদেশ অভিমুখে রোহিঙ্গা ঢলের পর আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নজরে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে। ‘জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান (জেআরপি) মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম শুরু করে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজা সংকট ও আফ্রিকার নতুন মানবিক বিপর্যয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের মনোযোগ সরে যেতে থাকে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে। ২০২৫ সালে জেআরপি প্রকল্পে ৯৩৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার আবেদন করা হলেও সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংগৃহীত হয়েছে ৩২৫ মিলিয়ন ডলারের কিছুটা বেশি। তহবিল ঘাটতি রয়েছে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। অথচ ২০১৮ সালে এ প্রকল্পের আবেদনের প্রায় ৯০ শতাংশ সংগৃহীত হয়। তহবিল সংকটের কারণে শরণার্থী শিবিরে সীমিত করা হয়েছে খাদ্য কুপন। থমকে গেছে স্বাস্থ্য প্রকল্প ও শিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্প। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যাওয়ার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে। আর্থিক অনটনে থাকা রোহিঙ্গারা মাদক পাচার, অস্ত্র বেচাবিক্রি, অপহরণ, হত্যাকাণ্ড ও চাঁদাবাজির মতো ঘটনায় সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। পুলিশের ডেটাবেজ অনুযায়ী, ২০১৮ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে বিভিন্ন অভিযোগে ২০৮টি মামলা হয়। ২০২৫ সালে ৯ মাসেই এ সংখ্যা বেড়ে হয়েছে পাঁচ গুণের বেশি। ‘জয়েন্ট প্রোটেকশন মনিটরিং রিপোর্ট’ অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে বিভিন্ন অপরাধে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মামলা হয়েছে ১ হাজার ৮৩টি।
একটি বিদেশি এনজিওতে কর্মরত মো. রাসেল বলেন, ২০১৭ সাল থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করে আসতেছি। বিদেশি এনজিওগুলো প্রথম প্রথম যেভাবে সাপোর্ট দিয়েছে বর্তমানে সে সাপোর্ট নেই। ফান্ড ক্রাইসিসের কারণে অনেক প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এক সময় ক্যাম্পে ১৫০ থেকে ২০০ এনজিও কাজ করত। সেখানে বর্তমানে কাজ করে মাত্র ৫-১০টি বিদেশি এনজিও। ফান্ড ক্রাইসিসের কারণে এনজিওগুলো কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে।