দেশের অন্তত ৯ হাজার এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের বিরুদ্ধে নীতিমালা অমান্য করে প্রতিষ্ঠানের ফান্ডের টাকা আত্মসাতে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
গত ১৭ মে হবিগঞ্জ সদরের হাজী আমির আলী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আবদুল গণি ও অফিস সহকারী রেজুনা আক্তারকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেয় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর।
ওই চিঠিতে বলা হয়, রেজিস্ট্রেশন ফি ৩০০ টাকার পরিবর্তে ১৫০০ টাকা আদায়, কৃষি ব্যবহারিক খাতা লেখার জন্য ১০০০ টাকা আদায়, শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের নামে কয়েক লাখ টাকা আদায়, কম্পিউটার ল্যাবের টাকা আত্মসাৎ, অনেক শিক্ষক-কর্মচারী নিয়মিত বিদ্যালয়ে না আসাসহ একাধিক অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। ২০২২ সালের ১০ অক্টোবর হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের বক্তারপুর আবুল খায়ের উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের অনিয়ম তদন্তের পর একটি প্রতিবেদন দেন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক অলিউল্লাহ মো. আজমতগীর। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন উন্নয়নের কথা বলে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক একজন দাতার কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা আদায় করেন কিন্তু তা ব্যাংকে জমা করেননি। এদিকে দুদক সূত্র জানান, শুধু হবিগঞ্জের ১৩১টি সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি এবং অনিয়মের তথ্য দুদকে জমা পড়েছে।
দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) আকতারুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘দুদক যে কোনো অভিযোগ যাচাইবাছাই করে আইন ও বিধি মোতাবেক অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করে।’
দিনাজপুর জেলা প্রশাসকের কাছে জমা পড়া এক তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দিনাজপুর নুরজাহান কামিল মাদ্রাসার সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সিরাজুল ইসলাম বিভিন্ন রসিদ বইয়ের মাধ্যমে ৩২ লাখ ৭৫ হাজার ৭৪৪ টাকা আদায় করেছেন, কিন্তু তা রেজিস্টার খাতায় উল্লেখ করেননি। এ ছাড়া শিক্ষকদের কাছ থেকে মৌখিকভাবে আদায় করেছেন ৪ লাখ ২৩ হাজার ৯২৫ টাকা, দান আদায়ের রসিদ বই দিয়ে আদায় করেছেন ৪ লাখ ৭৪ হাজার ২৫০ টাকা এবং আলিম পরীক্ষার কেন্দ্র ফি বাবদ আদায় করেছেন ৯০ হাজার টাকা। মোট ৪২ লাখ ৬৩ হাজার ৯১৯ টাকা আদায় করলেও তা ব্যাংকে জমা করেননি। একই সঙ্গে তাঁর অনুমোদনবিহীন অনিয়ম এবং প্রশাসনিক অসংখ্য অনিয়ম পাওয়া গেছে।
২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারের শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা পরিদর্শন প্রতিবেদন দুদকে পাঠানো হয় বলে জানা যায়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সেমিনার ফির নামে অর্থ আদায় করা হয়। সেই অর্থের ন্যূনতম ২০ শতাংশ দিয়ে সেমিনারের জন্য বই, জার্নাল ও পত্রিকা কেনার কথা থাকলেও তা কেনা হয়নি। সাময়িকী প্রকাশের জন্য শিক্ষার্থীরা ফি দিলেও সেই সাময়িকী আলোর মুখ দেখেনি। বিভিন্ন পরীক্ষায় শিক্ষকদের যে পরিমাণ সম্মানি পাওয়ার কথা, তাঁরা উত্তোলন করেছেন তার চেয়ে বেশি। এমন নানান অনিয়ম চিহ্নিত হয়েছে দেশের অন্তত ৫০টি সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এর মধ্যে ৪৩টি সরকারি কলেজ ও ৭টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে।
এ নিরীক্ষা প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর কলেজ ফান্ডের ২৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমানসহ আটজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় দুদক।
দুদক বলছে, নিয়মবহির্ভূতভাবে কলেজ ফান্ডের ২৪ কোটি ২৯ লাখ টাকা কলেজটির প্রধান হিসাবরক্ষক আকরাম মিয়ার ব্যক্তিগত হিসাবে এফডিআর করে রাখেন। এফডিআরের বৈধ উৎসের ব্যাখ্যা দিতে না পারায় অর্থ আত্মসাৎ-চেষ্টার অভিযোগে তাঁদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়।
অভিযোগ রয়েছে, চিহ্নিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অসৎ শিক্ষকরা বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে মিলে নানা রকম অনিয়ম করেন। অন্যান্য শিক্ষকের বেতনভাতা না দিয়ে নিজেরা আত্মসাৎ করেন। প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের টাকা নিজের পকেটে ঢোকান। এ ছাড়া এসব শিক্ষক নিজের কাছে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করছেন শিক্ষার্থীদের।