মৌসুম শেষ হলেও কমেনি ডেঙ্গুজ্বরের আগ্রাসন। এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৯৪ হাজার ৪০২ জন, মারা গেছেন ৩৮২ জন। এর মধ্যে শুধু নভেম্বরেই আক্রান্ত হয়েছেন ২৪ হাজার ৫৩০ জন, মারা গেছেন ৯৯ জন। ডেঙ্গুতে প্রাণ হারানোদের মধ্যে ২৬-৩০ বছর বয়সিদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ৫৫ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারিতে আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ১৬১ জন, মারা গেছেন ১০ জন। ফেব্রুয়ারিতে আক্রান্ত ৩৭৪ জন, মারা গেছেন ৩ জন। মার্চে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৩৬ জন। এপ্রিলে আক্রান্ত হয়েছেন ৭০১ জন, মারা গেছেন সাতজন। মে মাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৭৭৩ জন, মারা গেছেন তিনজন। জুন মাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৯৫১ জন, মারা গেছেন ১৯ জন। জুলাইতে আক্রান্ত হয়েছেন ১০ হাজার ৬৮৪ জন, মারা গেছেন ৪১ জন। আগস্টে আক্রান্ত হয়েছেন ১০ হাজার ৪৯৬ জন, মারা গেছেন ৩৯ জন। সেপ্টেম্বরে আক্রান্ত হয়েছেন ১৫ হাজার ৮৬৫ জন, মারা গেছেন ৭৬ জন। অক্টোবরে আক্রান্ত হয়েছেন ২২ হাজার ৫২০ জন, মারা গেছেন ৮০ জন। গত শনিবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বরে আরও পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬৩৬ জন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুজন, কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে একজন এবং চট্টগ্রামের পার্কভিউ হাসপাতালে একজনের মৃত্যু হয়েছে। জানা যায়, ডেঙ্গুর মৌসুম সাধারণত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত থাকে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসেও এর প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। মৌসুম শেষেও কমেনি ডেঙ্গুর প্রকোপ। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘অনেক রোগীকে যথেষ্ট বিলম্বে হাসপাতালে আনা হচ্ছে, একেবারে শেষ সময়ে। জেলা শহরগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা সম্ভব। কিন্তু অনেকেই ১০-১২ ঘণ্টার পথ পার হয়ে ঢাকায় রোগী নিয়ে আসছেন। বিলম্বে রোগী নিয়ে আসা মৃত্যুর একটি প্রধান কারণ।’ চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণ রয়েছে। এগুলো হলো- ডেঙ্গু শনাক্তে বিলম্ব, হাসপাতালে ভর্তি হতে দেরি এবং ফ্লুইড ব্যবস্থাপনায় ভুল। এই তিন কারণেই মৃত্যুহার বাড়ছে। অনেক রোগী প্রাথমিক পর্যায়ে জ্বরকে ‘সাধারণ জ্বর’ ভেবে সময় নষ্ট করেন। ফলে অনেক সময় প্লাজমা লিকেজ, মাল্টি অরগ্যান ড্যামেজসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিয়ে পরিস্থিতি জটিল করে তোলে। এ রকম সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে পৌঁছালে চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে যায়। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষষা প্রতিষ্ঠান- আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, রাজধানী পেরিয়ে এডিস মশার কারণে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। কিন্তু জেলা হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসার পর্যপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় চিকিৎসকরা ঝুঁকি না নিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছেন ঢাকায়। তারা রোগীকে বলে দিচ্ছেন, রোগীকে বাঁচাতে চাইলে ঢাকায় নিয়ে যান, আমাদের এখানে ভালো চিকিৎসা নেই। দরিদ্র রোগীরা টাকা জোগাড় করে বিভিন্ন জেলা থেকে হাসপাতালে আসতে আসতে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। রোগী শেষ মুহূর্তে এসে পৌঁছাচ্ছে হাসপাতালে। তখন চিকিৎসকদের বেশি কিছু করার থাকে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা) ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, এবার ডেঙ্গু সারা বছরেই হবে। ডিসেম্বর মাসেও হবে। বৃষ্টিপাত হলে পানি জমবে, তাতে ডেঙ্গু ডিসেম্বরে বেড়েও যেতে পারে। ডেঙ্গুতে এত আক্রান্ত হলো, মৃত্যু হলো কিন্তু সেটা নিয়ে আমাদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়কে বড় কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা গেল না। এত রোগীর মৃত্যু হওয়ার পরেও এত ভাবলেশহীন থাকাটা দুঃখজনক। আমাদের মূল মনোযোগ দিতে হবে মশা নিয়ন্ত্রণের দিকে। ডেঙ্গু শনাক্ত এবং চিকিৎসার দিকে। তা না হলে সামনের দিনগুলোতে মানুষের জীবনের ঝুঁকি আরও বাড়বে।