২৭ মে, ১৯৭১। বেলা ১১টার দিকে রাজাকারদের সহযোগিতায় পাক সেনারা অতর্কিত আক্রমণ করে ভাঙ্গা থানার আলগী ইউনিয়নের ছায়াসুনিবিড় চণ্ডীদাসদী গ্রামে। মাত্র এক থেকে দেড় ঘণ্টার অভিযানে পাক সেনা ও তাদের সহযোগী রাজাকাররা হিন্দু অধ্যুষিত ওই গ্রামের ২১ জনকে হত্যা করে। পাশাপাশি লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করে ঘটিয়ে দেয় নৃশংসতম ঘৃণ্য ট্র্যাজেডি। একাধিক ব্যক্তির বর্ণনা অনুযায়ী, পাক সেনারা তিন দিক থেকে হঠাৎ করে গ্রামটি আক্রমণ করে। একদল উত্তর দিকে নদীর পাড় দিয়ে, আরেক দল পূর্ব দিক দিয়ে, আরেক দল দক্ষিণ দিকের মাঠ দিয়ে একসঙ্গে আক্রমণ করে। এমনকি পাটখেতের ভিতর খুঁজে খুঁজে পাক সেনারা সেদিন গণহত্যা চালায়।
গ্রামের পূর্ব পাশেই আজিজুল শিকদারের বাড়ি। পাক সেনারা গ্রামে ঢুকেই প্রথমে আজিজুল শিকদারের কাছে জানতে চায় ‘মালাউন কাহা হায়?’ কথা বুঝতে পারেননি আজিজুল। সঙ্গে সঙ্গে তাকে গুলি করা হয়। প্রথম শহীদ আজিজুলের রক্তে লাল হয় চণ্ডীদাসদী গ্রামের মাটি।
হিন্দু অধ্যুষিত এ গ্রামে গণহত্যার হাত থেকে রেহাই পায়নি কোনো পরিবার। হত্যা করা হয় মল্লিক গোষ্ঠীর অন্নদা মল্লিক, পূর্ণচন্দ্র মল্লিক, নারায়ণ মল্লিক, মুন্নি মল্লিক, বেনি মাধব মল্লিকের ছেলে নিতাই মল্লিক ও অতুল মল্লিকের ছেলে নিতাই মল্লিককে। সরকার গোষ্ঠীর নিতাই সরকার, তাড়িনী সরকার, যোগেন্দ্র সরকার, মধুসূদন সরকার, শ্যামল সরকারকে। মজুমদার গোষ্ঠীর সতীশ মজুমদার, যজ্ঞেশ্বর মজুমদার, অমল মজুমদারকে। ভৌমিক গোষ্ঠীর রতিকান্ত ভৌমিক, সুরেন ভৌমিক, ক্ষিরদিনী ভৌমিককে। এ ছাড়া আরও হত্যা করা হয় সতীশ বিশ্বাস ওরফে জঙ্গল চৌকিদার, আজিজুল হক শিকদার, পরেশ চন্দ্র রায় ও ভুবন দাসকে। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, গ্রামের পূর্বপাশে পাক সেনারা মানুষ মারছে। এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর অষ্টম শ্রেণির ছাত্র স্বদেশ রায় গ্রামের দক্ষিণ পাশে পাটখেতের ভিতরে শেয়ালের গর্তে গিয়ে লুকিয়েছিল। তাকে গর্ত থেকে বের করে পেছন দিক থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
প্রতিদিনের মতো ইউনিয়ন বোর্ড অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন সতীশ বিশ্বাস ওরফে জঙ্গল চৌকিদার। গ্রামের গুলির শব্দ শুনে এগিয়ে এলেই বাড়ির সামনের রাস্তায় তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মারা যাওয়ার সময় তার মাথায় চৌকিদারের টুপি, গায়ে সরকারি জামা ছিল।
সেদিন পাক সেনারা চণ্ডীদাসদী গ্রামের পীতাম্বর সরকারের দুই ছেলে তাড়িনী সরকার ও যোগেন্দ্র সরকারকে একসঙ্গে গুলি করে হত্যা করেছিল। রাস্তার পাশে ঝোপের ভিতরে পালিয়ে ছিলেন বৃদ্ধ রতিকান্ত ভৌমিক। তাকে সেখানে গুলি করে হত্যা করা হয়।
একই সময়ে হত্যার শিকার হয়েছিলেন ওই গ্রামের যজ্ঞেশ্বর মজুমদার, তার ভাতিজা অমল মজুমদার, যজ্ঞেশ্বরের জামাই নিতাই সরকার।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে চণ্ডীদাসদী গ্রামের বাসিন্দা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সুধীন কুমার সরকার বলেন, সেদিন শুধু পাক সেনারা আমাদের গ্রামের ২১ জনকেই হত্যা করেনি, বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। ঘরের টিন পর্যন্ত লুটপাট করে নিয়ে গিয়েছিল। সেদিন ধর্মীয় বিধি অনুযায়ী লাশ দাফন করা হয়নি। পাশের গ্রামের মানুষের সহযোগিতায় লাশ মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিল।