মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে এবং তাঁর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একই মামলার গ্রেপ্তারকৃত আসামি সাবেক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে ১০ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনালে হাজিরের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রসিকিউশনের দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়ে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ গতকাল এ আদেশ দেন।
জয় এবং পলকের বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্টে গণ অভ্যুত্থান চলার সময় ইন্টারনেট বন্ধ করে আন্দোলনকারীদের হত্যার তথ্য আড়াল, হত্যাযজ্ঞে উসকানি, ষড়যন্ত্র ও সম্পৃক্ত থাকার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের তিনটি অভিযোগ এনেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়। অন্যদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বিরুদ্ধেও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেছে প্রসিকিউশন। সালমান ও আনিসুল আগে থেকেই গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। গতকাল আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়ে এ মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার দেখাতে ১০ ডিসেম্বর হাজির করার নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানে হত্যায় উসকানি, লেথাল উইপেন (মারণাস্ত্র) ব্যবহারের নির্দেশনা, আন্দোলন দমনের ষড়যন্ত্রসহ পাঁচটি অভিযোগ এনেছে প্রসিকিউশন।
এর আগে প্রসিকিউশনের পক্ষে গাজী এম এইচ তামীম দুটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে উপস্থান করে জয়ের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও পৃথক দুই মামলায় গ্রেপ্তার তিন আসামিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার আর্জি জানান। পরে জয় ও পলকের বিরুদ্ধে আনা তিন অভিযোগের বর্ণনা তুলে ধরে প্রসিকিউটর তামীম সাংবাদিকদের বলেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগটি হচ্ছে-জুলাই আন্দোলনের সময় তৎকালীন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুকে পর পর তিনটি স্ট্যাটাস দেন। সেখানে তিনি আন্দোলনকারীদের আবারও রাজাকারের নাতিপুতি সম্বোধন করে কথা বলেন। তিনি এ-ও বলেছিলেন, তাদের (আন্দোলনকারী বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের) এ দেশে থাকার কোনো অধিকার নেই। পাকিস্তানে চলে যেতে বলেছিলেন। এ ধরনের উসকানিমূলক বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ, যুবলীগ হামলা করে। ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদ শহীদ হন এবং সারা বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়।’ দ্বিতীয় অভিযোগ তুলে ধরে প্রসিকিউটর তামীম বলেন, ‘জুলাই গণ অভ্যুত্থান চলাকালে যে মরণাস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, সেই হত্যার নির্দেশ কার্যকরের জন্য সজীব ওয়াজেদ জয়ের পরামর্শে তৎকালীন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক প্রথমে ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দেন। এরপর সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে হত্যা এবং নির্যাতনের তথ্য আড়াল করে হত্যাযজ্ঞ পরিচালনায় সহায়তা এবং সম্পৃক্ত থাকেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা শহরসহ বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ছাত্র-জনতা নিহত হয়।’
তৃতীয় অভিযোগের বিষয়ে প্রসিকিউটর তামীম জানান, ‘যারা মাঠে থেকে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে এ দুজন কোনো ব্যবস্থা নেননি এবং এ অপরাধ সংঘটনে কোনো বাধা দেননি। অপরাধ সংঘটন বন্ধে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন।’ জুলাই গণ আন্দোলনের সময় জয় দেশে ছিলেন না। কীসের ভিত্তিতে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(১) ধারায় পরিষ্কার বলা আছে, বাংলাদেশের কোনো নাগরিক বাংলাদেশে থেকে অথবা বাংলাদেশের বাইরে থেকে যদি মানবতাবোরধী অপরাধ করেন তাহলে তাকে এ ট্রাইব্যুনাল বিচারের মুখোমুখি করতে পারবেন। বাংলাদেশের নাগরিক নন, এমন ব্যক্তিও যদি বাংলাদেশে থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেন, তার বিচারও ট্রাইব্যুনাল করতে পারেন। সে সময় উনি (জয়) দেশে থাকেন বা না থাকেন, উনি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ছিলেন।’ গত বছর ৫ আগস্ট জয়ের কথায় বা পরামর্শে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছিলেন উল্লেখ করে এই প্রসিকিউটর বলেন, ‘এ মামলায় দুটি জিনিস আমরা ট্রাইব্যুনালকে দেখিয়েছি। একটি হচ্ছে সালমান এফ রহমানের সঙ্গে শেখ রেহানার একটি মোবাইল কথোপকথন, যেটি তদন্তকারী সংস্থা পেয়েছে। সেখানে শেখ রেহানা বলছেন, আপনি জয়ের কথা শোনেন। জয়ের কথা অনুযায়ী আপনি চলে যান। শুধু তাই নয়, ৫ আগস্টের যে রিপোর্ট আমরা পেয়েছি, সেখানে পুলিশ এবং আর্মি যখন তাঁকে (শেখ হাসিনাকে) পদত্যাগ করতে বলছেন, উনি পদত্যাগে রাজি হচ্ছিলেন না। তখন জয়ের সঙ্গে কথা বলে উনি পদত্যাগ করতে রাজি হন। তার মানে উনি (শেখ হাসিনা) সব ক্ষেত্রে সজীব ওয়াজেদ জয়ের উপদেশ গ্রহণ করে সব কার্যক্রম এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন।’ তবে সালমান এফ রহমান ও আনিসুল হকের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে বিস্তারিত কিছুই জানাননি প্রসিকিউটর তামীম। চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয় থেকেও আনুষ্ঠানিক কিছু জানানো হয়নি।
হাসিনা ও জয়কে ফেরাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দুদকের চিঠি : ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে ফেরাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
গতকাল দুদক সূত্র জানান, ১ ডিসেম্বর দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠিটি পাঠানো হয়। পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লট জালিয়াতির ঘটনায় তাঁদের অভিযুক্ত করা হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়, শেখ হাসিনা ও তাঁর ছেলে বিদেশে পালিয়ে গেছেন। ন্যায়বিচারের স্বার্থে আসামিদের অবস্থান চিহ্নিত করে দেশে ফিরিয়ে এনে আইনের মুখোমুখি করা প্রয়োজন।
দুদক জানায়, শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থান করছেন। সজীব ওয়াজেদ জয় আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। পরিবারের অন্য সদস্যরাও বর্তমানে দেশের বাইরে আছেন। শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের ২৭ নম্বর সেক্টরে ছয়টি প্লট বরাদ্দে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে গত বছরের ডিসেম্বরে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। এরপর এ বছরের ১২ জানুয়ারি ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনিয়মের অভিযোগে ছয়টি মামলা করে সংস্থাটি। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে শেখ হাসিনা, তাঁর ছেলে জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, বোন শেখ রেহানা, রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি, মেয়ে টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তীকে। এ ছয় মামলার সব কটিতেই আসামি করা হয়েছে শেখ হাসিনাকে। অন্যদেরও কেউ কেউ একাধিক মামলার আসামি। এসব মামলায় ৩১ জুলাই ঢাকার দুই বিশেষ জজ আদালত অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। ২৮ নভেম্বর রায়ে আদালত তাঁদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন।