আওয়ামী লীগ শাসনামলে দুর্নীতি দমন কমিশন ছিল বিরোধী দলকে হয়রানি করার অস্ত্র। ৫ আগস্টের পর দুর্নীতি দমন কমিশনকে ঢেলে সাজানো হয়। দুদক সংস্কারে গঠিত হয় কমিশন। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশন কতটা বদলেছে?
দুদকের কর্মকাণ্ডে খুশি নন দুদক চেয়ারম্যান নিজেই। গত ২৩ নভেম্বর, গণশুনানিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন বলেছেন, শুধু দীর্ঘসূত্রতাই নয়, দুদকের ভিতরও রয়েছে দুর্নীতি। সিলেটের রিকাবীবাজারের কবি নজরুল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত দুদকের গণশুনানি শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ স্বীকারোক্তি দেন চেয়ারম্যান মোমেন। দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় সিলেটের আয়োজনে এবং জেলা প্রশাসন ও দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সহযোগিতায় সকাল ১০টা থেকে গণশুনানি শুরু হয়। এতে ৭৩টি অভিযোগ উত্থাপন ও শুনানি হয়। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অভিযুক্ত কর্মকর্তারাও এতে অংশ নেন। গণশুনানি শেষে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘যাঁরা সেবাদাতা- তাঁরা মূলত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। সরকারি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই সেবাগ্রহীতাদের অভিযোগ আছে। আমরা নিয়মিত রেইড করছি, কিছুটা উপকারও হচ্ছে। বিশ্বজিৎ দাস নামক একজন অভিযোগকারী ওসমানী মেডিকেল কলেজের লাইব্রেরিয়ান পদে চাকরির জন্য এক কর্মচারী তার কাছ থেকে ২ লাখ টাকা নিয়েও চাকরি দেননি, টাকাও ফেরত না দেওয়ার অভিযোগ উত্থাপন করলে দুদক চেয়ারম্যান তাৎক্ষণিকভাবে ওই কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত এবং তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। এ ছাড়াও হাসপাতালে টিকিটের দাম বাবদ অতিরিক্ত টাকা নেওয়া, টাকা ছাড়া শয্যা না দেওয়া, পাসপোর্ট অফিসে ঘুষ লেনদেন, কম্পোজের দোকানগুলোতে অবৈধ অর্থের লেনদেন, জালালাবাদ গ্যাসের সংযোগে অনিয়ম- ইত্যাদি অভিযোগও উত্থাপন করা হয় এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘দুদকে অনেক কর্মী দুর্নীতির তথ্য চাপা দেন, তবে গণমাধ্যম তা করে না। তাই গণমাধ্যমকে সবসময় গুরুত্ব দেই আমরা।’
দুদক চেয়ারম্যানের এমন বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায় গত দেড় বছরে দুদকের একাধিক তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। তদন্তের নামে অবৈধভাবে অর্থ আদায়। ভুয়া দুর্নীতির অভিযোগ এনে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে দুদকের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এরকম অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুদকের দুই ডজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুদক পুরোপুরি দুর্নীতিমুক্ত হতে পারেনি। এদিকে দুদককে সংস্কারের লক্ষ্যে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এই আইন কার্যকর হলে, দুদকের পরিধি আরও বড় হবে। একই সঙ্গে দুদকের কাজের প্রতিবেদন এখন থেকে ছয় মাস পরপর অনলাইনে (ওয়েবসাইটে) দিতে হবে এবং দুদক কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব দিতে হবে।
এসব বিধান রেখে দুর্নীতি দমন কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশের খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্র্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। গত বৃহস্পতিবার ২৭ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে তেজগাঁওয়ে তাঁর কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সংশোধনীতে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো, বর্তমানে চেয়ারম্যানসহ তিনজন কমিশনারের সমন্বয়ে এই কমিশন কাজ করে। এখন পাঁচজনের কমিশন করা হচ্ছে। এর মধ্যে একজন নারী এবং আরেকজন তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হবেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের বিষয়ে অন্তর্র্বর্তী সরকার একটি সংস্কার কমিশন করেছিল। তাদের অনেক সুপারিশ ছিল। সেই আলোকে দুদককে কীভাবে আরও কার্যকর একটি প্রতিষ্ঠান করা যায়, সে বিষয়ে করা অধ্যাদেশের খসড়াটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই সংশোধনীতে সন্তুষ্ট নয়, টিআইবি। ‘বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি’ গঠনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সুপারিশ বাদ দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন অধ্যাদেশ চূড়ান্ত অনুমোদন করায় গভীর হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) জবাবদিহির বাইরে রাখার মাধ্যমে রাষ্ট্র সংস্কার কেবলই ফাঁকা বুলি কি না, এ প্রশ্নও তুলেছে টিআইবি। এক বিবৃতিতে টিআইবি বলেছে, ক্ষমতাসীনদের ইঙ্গিতে কেবল প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে পরিচিত দুদকের উত্তরণের লক্ষ্যে ‘বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি’ গঠনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সুপারিশ করা হয়েছিল। এই সুপারিশ বাদ দেওয়া শুধু হতাশাজনক নয়, সরকারের অভ্যন্তরে প্রায় সব ক্ষেত্রে সংস্কারবিরোধী মহলের ষড়যন্ত্রের কাছে রাষ্ট্র সংস্কারের অভীষ্টের জিম্মিদশারও পরিচায়ক। জুলাই সনদে স্বাক্ষরকারী সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য ও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সম্মতির পরও চূড়ান্ত অধ্যাদেশে এ সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার বিষয়টি রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সরকারের অনাগ্রহের ইঙ্গিত বলে মনে করে টিআইবি।
দুদককে প্রকৃত অর্থে একটি জবাবদিহিমূলক, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার এই কৌশলগত সুপারিশটি অনুধাবনে সরকার ব্যর্থ হয়েছে, যা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় বলে উল্লেখ করে টিআইবি আরও বলেছে, রাষ্ট্র সংস্কারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারের জন্য এটি স্ববিরোধী ও সংস্কার পরিপন্থি নজির। ঐকমত্য কমিশনের প্রধান ও ১১টি সংস্কার কমিশন প্রতিষ্ঠার যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা দুদককে জবাবদিহির বাইরে রাখার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলসহ দেশবাসীকে কি এই বার্তা দিতে চাইছেন যে রাষ্ট্র সংস্কার কেবলই ফাঁকা বুলি-এ প্রশ্নও বিবৃতিতে তুলেছে টিআইবি।
বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিগত দুই দশকের অভিজ্ঞতা, অংশীজনদের মতামত, আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রেক্ষিত বিবেচনায় দুদক যাতে ক্ষমতাসীনদের হয়রানির হাতিয়ার হিসেবে চলমান না থাকে, সে লক্ষ্যে দুদক সংস্কার কমিশন ‘বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি’ গঠনের সুপারিশ করেছিল। জন্মলগ্ন থেকে দুদক যেভাবে জন-আস্থার সংকটে ভুগছে এবং স্বার্থান্বেষী মহলের ক্রীড়নক হিসেবে ক্ষমতাসীনদের সুরক্ষা আর প্রতিপক্ষকে হয়রানির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, তা থেকে উত্তরণ ঘটাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ প্রস্তাবটি করা হয়েছিল।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন, ‘নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে অন্তত সাতজন উপদেষ্টা এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন। অথচ তাঁরা জানেন যে এই প্রস্তাবে জুলাই সনদে স্বাক্ষরকারী সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে। জুলাই সনদ লঙ্ঘনের এরূপ উদাহরণ সৃষ্টি করার আগে সরকার কেন ভাবছে না যে এর মাধ্যমে রাজনৈতিক দলকে তারা নিজেরাই জুলাই সনদ লঙ্ঘনে উৎসাহিত করছে? তাহলে কেন এত রক্তক্ষয়ী আত্মত্যাগ? দুর্নীতির কার্যকর নিয়ন্ত্রণের উপায় রুদ্ধ করে কীসের রাষ্ট্র সংস্কার?’
অধ্যাদেশটির যে খসড়াটি টিআইবির দেখার সুযোগ হয়েছিল, তা অনেকাংশে বিদ্যমান আইনের তুলনায় উন্নত মানের হওয়ায় টিআইবি সরকারকে সাধুবাদ জানাচ্ছে। তবে নির্ভরযোগ্য সূত্রের তথ্যানুযায়ী, চূড়ান্ত অধ্যাদেশে উল্লিখিত বিষয়টির পাশাপাশি আরও কিছু ঐকমত্য-অর্জিত গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সুপারিশ বাদ দেওয়া হয়েছে, যা সরকারের অভ্যন্তরে স্বার্থান্বেষী ও প্রভাবশালী মহলের দুর্নীতি-সহায়ক ও সংস্কার-পরিপন্থি অবস্থান ছাড়া আর কিছু হতে পারে না বলে উল্লেখ করেছে টিআইবি।