ভেজাল পণ্যে সয়লাব বাজার। বাহারি শরবত, রকমারি খাবারে ‘ফুড গ্রেড’-এর নামে ব্যবহার করা হচ্ছে কারখানায় ব্যবহৃত রং। দীর্ঘদিনের পোড়া তেলে ভাজা হচ্ছে বেগুনি, পিঁয়াজু, চপ। এসব রাসায়নিক উপাদানে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। কিডনি, লিভার, ক্যানসার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জাকারিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা নিয়মিত মনিটরিং, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, খাদ্যের নমুনা পরীক্ষা করে ক্ষতিকর রাসায়নিক শনাক্ত করি। সম্প্রতি ক্যাওড়া জল, গোলাপ জল পরীক্ষা করে অননুমোদিত রাসায়নিক পাওয়া গেছে। এসব ক্ষতিকর পণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নিতে ব্যবসায়ীদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। রাসায়নিক উপাদান, রঙে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।’
তিনি আরও বলেন, ‘নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছি। নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। আমাদের বেশ কিছু সংকট আছে। প্রতি জেলায় মাত্র একজন কর্মকর্তা রয়েছেন। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ল্যাবরেটরি না থাকায় বাইরে থেকে নমুনা পরীক্ষা করাতে হয়। এসব ল্যাবরেটরির সক্ষমতা নিয়েও আলোচনা রয়েছে। এর সমাধানে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনায় ল্যাব স্থাপন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এগুলো চালু হলে কার্যক্রম আরও জোরদার হবে।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে প্রতি বছর বিশ্বের প্রায় ৬০ কোটি মানুষ ভেজাল ও দূষিত খাদ্য গ্রহণের কারণে অসুস্থ হয়। এর মধ্যে মারা যায় ৪ লাখ ৪২ হাজার। এ ছাড়া দূষিত খাদ্য গ্রহণের কারণে পাঁচ বছরের কম বয়সের আক্রান্ত হওয়া ৪৩ শতাংশ শিশুর মধ্যে মৃত্যুবরণ করে ১ লাখ ২৫ হাজার। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের কারণে প্রতি বছর দেশে ৩ লাখ লোক ক্যানসারে, ২ লাখ কিডনি রোগে, দেড় লাখ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া গর্ভবতী মা ১৫ লাখ বিকলাঙ্গ শিশুর জন্মদান করেন। ভেজাল খাদ্য গ্রহণে হেপাটাইটিস, কিডনি, লিভার ও ফুসফুস সংক্রমিত রোগী দিনদিন বেড়ে চলেছে।
সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালের অধ্যাপক স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত চিকিৎসক কামরুল ইসলাম বলেন, ‘বাইরে থেকে কেনা খাবারে বিভিন্ন অস্বাস্থ্যকর উপাদান মেশানো হয়। শরীরের জন্য ক্ষতিকর রং, প্রিজারভেটিভ, ফরমালিন ব্যবহার করা হয়। এসব উপাদান মানুষকে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলে।’
লিভারের সমস্যার পাশাপাশি কিডনির ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় এসব খাবার। অনেক উপাদান দীর্ঘমেয়াদি ক্ষত তৈরি করে এবং দুরারোগ্য রোগ জন্ম দেয়। তাই এসব খাবার থেকে দূরে থাকতে হবে। বাড়িতে স্বাস্থ্যকর উপায়ে বানানো খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়তে হবে।’ ব্যবসায়ীদেরও খাবারে ভেজাল দেওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান তিনি।
১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে খাদ্যে ভেজাল দেওয়া এবং ভেজাল খাদ্য বিক্রির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। এ ছাড়া ১৪ বছরের কারাদণ্ডেরও বিধান রয়েছে এ আইনে। জাতীয় জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ২০১৮ সালে সারা দেশে ৪৩টি ভোগ্যপণ্যের (খাদ্যদ্রব্য) ৫ হাজার ৩৯৬টি নমুনা পরীক্ষা করে। ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার পর এ ৪৩ পণ্যেই ভেজাল পাওয়া গেছে। বর্তমানে বাজারে খাদ্যসামগ্রীর মানের অবস্থা একই।
এ ব্যাপারে শ্যামলী ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, ‘ভেজাল খাবার খাওয়ার ফলে শরীরে বাসা বাঁধে রোগব্যাধি। ক্ষতিকর রং, বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান, পোড়া তেল খাওয়ার ফলে পেটে সমস্যা হয়। ধীরে ধীরে আলসার হয়, একটা সময় লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব খাবার খেলে হৃদরোগ, কিডনি সমস্যা এমনকি ক্যানসার পর্যন্ত হয়। গর্ভবর্তী নারীদের জন্য এসব ভেজাল খাবারের ক্ষতি কয়েক গুণ বেশি। গর্ভের শিশু মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভেজাল খাবারে। এটা সমস্ত প্রাণিকুল এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। তাই সুস্থ সমাজ গড়ে তুলতে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে।’