ট্রানজিটের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে স্থলবেষ্টিত ভুটানে পণ্য পরিবহনের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম (ট্রায়াল রান) শুরু হচ্ছে। আজ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ট্রায়াল রানের প্রথম চালানের ছয় টন পণ্য খালাস করা হবে। এরপর ভারত হয়ে ভুটানে যাওয়ার পথে বাংলাদেশ কাস্টমসের চারজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা এসকট করে এ চালানটিকে বুড়িমারী বন্দর পর্যন্ত পৌঁছে দেবেন। এর আগে থাইল্যান্ডের ল্যাম চাবাং বন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে আসা হয় ট্রানজিটের এসব পণ্য। ভুটানের একটি প্রতিষ্ঠান পণ্যগুলো আমদানি করছে। এতে রয়েছে চকলেট, শ্যাম্পো, শুকনো পাম ফল ও জুসজাতীয় পণ্য। ট্রানজিট হিসেবে বাংলাদেশের বন্দর এবং সড়কপথ ব্যবহারের জন্য ভুটানকে বিভিন্ন ফি ও মাশুল পরিশোধ করতে হয়েছে। প্রথম চালানের জন্য বিভিন্ন চার্জ বাবদ ৮৫ হাজার টাকা আদায় করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম বন্দরে খালাসের দায়িত্বে নিয়োজত সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান এনএম ট্রেডিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহীদুল আলম খান বলেন, কাস্টমসসংক্রান্ত সব কাজ শেষ। মঙ্গলবার খালাসের কথা ছিল। শিপিং এজেন্টের চার্জ বাকি থাকায় তা সম্ভব হয়নি। আজ ডেলিভারি নেওয়া হবে। তিনি জানান, ট্রানজিট পথ অনুযায়ী, চালানটি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সড়কপথে বাংলাদেশের বুড়িমারী স্থলবন্দর হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চ্যাংড়াবান্ধা স্থলবন্দরে প্রবেশ করবে। এরপর ভারতের শিলিগুড়ি হয়ে ভুটানের স্থলবন্দরে পৌঁছানোর কথা। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের উপকমিশনার এইচ এম কবির জানান, যেহেতু পণ্য বাংলাদেশে ভোগ বা ব্যবহার হবে না, তাই এখানে কোনো কাস্টমস ডিউটি নেই। তবে ট্রানশিপমেন্ট চার্জ, সড়ক ব্যবহারের মাশুল, ব্রিজের টোল, ডকুমেন্টেশন ও স্ক্যানিং চার্জসহ বিভিন্ন খাতে চালানটি থেকে ৮৫ হাজার ৬৬৬ টাকা আদায় করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, পণ্য এলে বন্দর নিয়ম অনুযায়ী চার্জ পাবে। যত বেশি পণ্য আসবে তত বেশি লাভ হবে বন্দরের।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে ট্রানজিট চুক্তি ও প্রটোকল সই হয়েছিল ২০২৩ সালে। চুক্তি সইয়ের প্রায় দুই বছর পর এই পরীক্ষামূলক চালানের পরিবহন শুরু হলো। চালানটি গত সেপ্টেম্বরে বন্দরে পৌঁছালেও সরকারি সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে মাশুল ও ফি নির্ধারণ এবং অন্যান্য কাস্টমস প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে প্রায় দুই মাস সময় লেগে যায়। ১৭ নভেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে আদেশ জারি হয় এবং ২০ নভেম্বর সড়কের টোল ও মাশুলের বিষয়ে এনবিআরকে চিঠি দেওয়ার পর শুল্কায়ন কার্যক্রম শুরু হয়। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, পরীক্ষামূলক পরিবহন সফল হলে নিয়মিত পণ্য পরিবহন শুরু হবে। এতে শুধু ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে না বরং বাংলাদেশ সরকার ট্রানজিট ফি ও চার্জ থেকে রাজস্ব আয় করতে পারবে।
চট্টগ্রামের নিউমুরিং টার্মিনাল নিয়ে রায় ৪ ডিসেম্বর : চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে যে চুক্তি করতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, সেই চুক্তি প্রক্রিয়ার বৈধতা প্রশ্নে জারি করা রুলের শুনানি শেষ হয়েছে। এ বিষয়ে রায়ের জন্য আগামী ৪ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেছেন হাই কোর্ট। গতকাল চূড়ান্ত শুনানির পর রায়ের এদিন ধার্য করেন বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি ফাতেমা আনোয়ারের হাই কোর্ট বেঞ্চ। রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম, ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন ও কায়সার কামাল। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ অনীক রুশদ হক।
‘নিউমুরিং টার্মিনালে সবই আছে, তবু কেন বিদেশির হাতে যাচ্ছে’ শিরোনামে গত ২৬ এপ্রিল একটি পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদন যুক্ত করে চলতি বছর জুলাইয়ে বাংলাদেশ যুব অর্থনীতিবিদ ফোরামের সভাপতি মির্জা ওয়ালিদ হোসাইন হাই কোর্টে রিট করেন। রিটে চুক্তি প্রক্রিয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়। এই রিটে প্রাথমিক শুনানির পর গত ৩০ জুলাই হাই কোর্ট রুল দেন। কেন এই চুক্তি প্রক্রিয়াটি বাংলাদেশ সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) আইন, ২০১৫ এবং পিপিপি প্রকল্প বাস্তবায়ন নীতিমালা, ২০১৭-এর লঙ্ঘন ও স্বেচ্ছাচারী ঘোষণা করা হবে না, জানতে চাওয়া হয় রুলে।
পিপিপি আইন, ২০১৫ ও পিপিপি প্রকল্প বাস্তবায়ন নীতিমালা, ২০১৭-এর অধীনে সরকারি অংশীদারির ভিত্তিতে সুষ্ঠু, প্রতিযোগিতামূলক উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান নিশ্চিতের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, রুলে তা-ও জানতে চাওয়া হয়। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের কাছে রুলের জবাব চান হাই কোর্ট। গতকাল সেই রুলেই চূড়ান্ত শুনানি হয়। শুনানির পর অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ‘এনটিসি নিয়ে একটা কোম্পানির সঙ্গে প্রাথমিক কথাবার্তা চলছে। সেটি নিয়ে জনস্বার্থের একটি মামলা করে জাতির সামনে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য উপস্থাপন করা হচ্ছে যে, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘রিট আবেদনকারী পক্ষের দাবি, এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হলে পিপিপি আইনের ৭ ধারার অধীনে প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিপরিষদ থাকতে হবে। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিপরিষদ নেই, সেই কারণে এনটিসির ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না। আমরা বলেছি, প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিপরিষদ যে কাজ করতে পারেন, সংবিধান অনুসারে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং উপদেষ্টারা তা করতে পারেন।’
শুনানির পর রিটকারী পক্ষের আইনজীবী আহসানুল করিম সাংবাদিকদের বলেন, ‘কোনো রকম উন্মুক্ত দরপত্র ও প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়া ছাড়া বিগত সরকার ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড নামের একটি কোম্পানির সঙ্গে সমঝোতা স্মারকে (এমওইউ) স্বাক্ষর করে। আশা করা হয়েছিল, নতুন সরকার আসার পর এসব কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেবে। কিন্তু দেখা গেছে, ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে কার্যক্রম অব্যাহত রেখে প্রক্রিয়াটিকে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনকে (আইএফসি) দিয়ে প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে। সরকারের ইচ্ছা হচ্ছে কোনো প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়া অর্থাৎ উন্মুক্ত দরপত্র ছাড়াই এনসিটি বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া।’