দেশে পছন্দমতো কাজ না পাওয়ায় তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে হতাশা বাড়ছে। কাজের সন্ধানে তারা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। স্বল্পশিক্ষিত তরুণদের প্রধান গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। তবে উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় অনেকেই ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হতে চেষ্টা করছেন। তাদের কেউ কেউ সফল হলেও অনেকে ব্যর্থ হয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছেন বা বিভিন্ন দেশের কারাগারে বন্দিজীবন যাপন করছেন। মাফিয়া চক্রের নির্যাতন ও মুক্তিপণ দিতে গিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন অনেকে। এসব ঝুঁকি নিয়েও বিদেশ যেতে মরিয়া হয়ে উঠছে তরুণরা। অর্থনীতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তরুণ প্রজন্ম কোনো কিছু না বুঝেই বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এটা ভবিষ্যৎ মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য হুমকি। এ সংকটের মূল কারণ হলো দেশে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের অভাব। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সাবেক মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, মূলত বেকারত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই তরুণরা এখন বিদেশমুখী। স্বাভাবিক প্রক্রিয়া কঠিন হওয়া এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রক্রিয়া চালু না থাকার কারণে মানুষ অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে অবৈধ অভিবাসন বাড়ছে।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি বছর শ্রমবাজারে ২৮ থেকে ৩০ লাখ তরুণ-তরুণী নতুন করে যুক্ত হচ্ছেন। দেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থান হয় ১২ থেকে ১৩ লাখের। তাদের মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশের কর্মসংস্থান হয় মজুরিভিত্তিক অনানুষ্ঠানিক খাতে, বাকিরা তুলনামূলক মানসম্পন্ন চাকরিতে যান। প্রতি বছর ১০ থেকে ১১ লাখ মানুষ প্রবাসে যান।
গত দুই বছরে ২০ লাখের বেশি তরুণ-তরুণী বিভিন্ন দেশে গেছেন। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৯ লাখ ৯৫ হাজার ৮৫৩ জন কর্মী বৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। বাংলাদেশি কর্মীদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে আছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। এ বছর বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি কর্মী গেছেন সৌদি আরবে। এরপরই রয়েছে কাতার, সিঙ্গাপুর, কুয়েত, মালদ্বীপ, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, কম্বোডিয়া ও ইতালি। এর বাইরেও তরুণ জনগোষ্ঠীর বিশাল একটি অংশ অবৈধভাবে বিদেশে যেতে চান। যাদের অধিকাংশই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যেতে আগ্রহী। ইউরোপীয় সীমান্ত ও উপকূলরক্ষী সংস্থা ফ্রনটেক্সের তথ্য অনুযায়ী, এ রুট ব্যবহার করে ইউরোপে প্রবেশের শীর্ষে রয়েছেন বাংলাদেশিরা। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর দিয়ে ১ লাখ ৬ হাজার ৫৯৮ জন বাংলাদেশি ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছেন।
জানা গেছে, অবৈধভাবে ইউরোপে যেতে আগ্রহী বাংলাদেশি তরুণদের বয়স ৩১ থেকে ৩৫ বছর। এ পথে ইউরোপে যেতে তাদের ৩০-৪০ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। ঢাকা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলার তরুণরা সবচেয়ে বেশি অবৈধ পথে ইউরোপে পাড়ি জমাতে আগ্রহী। সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকে নৌকাডুবিতে মারা যান। মাফিয়া চক্রের খপ্পরে পড়ে অনেকে নির্যাতনের শিকার হন। অনেককে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। অনেকে সীমান্ত রক্ষা বাহিনী ও অভিবাসন কর্মকর্তাদের হাতে আটক হন। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে কমপক্ষে ১ হাজার ২৯৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে উৎপাদন খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি স্থবির হয়েছে। এর বদলে কম উৎপাদনশীল খাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নারী এবং তরুণরা। দেশের প্রতি পাঁচজন নারীর মধ্যে একজন বেকার। রাজধানী ঢাকার বাইরে কর্মসংস্থান তৈরি একেবারে স্থবির হয়ে গেছে। ১৫-২৯ বছর বয়সি তরুণ-তরুণীর প্রায় অর্ধেক কম মজুরিতে কাজ করছেন, যা শ্রমবাজারে চাহিদা ও দক্ষতার মধ্যে অসঙ্গতির ইঙ্গিত দেয়।