বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে ইতিবাচক ও নেতিবাচক সূচকের দ্বৈত চাপে রয়েছে উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, সার্বিকভাবে অর্থনীতি সংগ্রাম করছে। একই সঙ্গে জীবিকার সংগ্রামও চলছে। তিনি অর্থনীতির নেতিবাচক সূচকগুলো তুলে ধরে বলেন, দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ মূল্যস্ফীতি, প্রকৃত মজুরি নিম্নমুখী, কর্মসংস্থানে স্থবিরতা, রপ্তানিতে শ্লথগতি ও বিনিয়োগে ভাটার অবস্থা চলছে। তবে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারত, সেটা হয়নি। আবার আরো ভালোও হতে পারত, সেটিও ঘটেনি।
সোমবার রাজধানীর শেরেবাংলানগরের এনইসি সম্মেলনকক্ষে পরিকল্পনা কমিশন আয়োজিত ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা ২০২৫ এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অগ্রগতি প্রতিবেদন ২০২৫’ প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে তিনি এ মন্তব্য করেন।
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ-জিইডির সদস্য (সচিব) ড. মনজুর হোসেন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অতিরিক্ত সচিব ড. মুনিরা বেগম।
আলোচনায় অংশ নেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাহবুবুল্লাহ। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন পরিকল্পনা সচিব এস এম শাকিল আখতার, এনবিআর চেয়ারম্যান এম আবদুর রহমান খান, অর্থ বিভাগের সচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদার, এসডিজি প্রধান সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মোহাম্মদ শফিকুল আলম এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, অর্থনীতিতে ইতিবাচক কিছু অগ্রগতি দেখা গেলেও নেতিবাচক সূচকগুলো আরো ভারী।
ইতিবাচক দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে রেমিট্যান্স প্রবাহ নতুন উচ্চতায় ওঠা, অর্থপাচার কমে আসা, রাজস্ব আদায়ে গতি পাওয়া এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ মোটামুটি স্থিতিশীল থাকা। প্রাকৃতিক ঝুঁকিতে অর্থনীতি নড়লেও গ্রাস করেনি। তবে নেতিবাচক চিত্র হলো, দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ মূল্যস্ফীতি, প্রকৃত মজুরি নিম্নমুখী, কর্মসংস্থানে স্থবিরতা, রপ্তানিতে শ্লথগতি ও বিনিয়োগে ভাটা। বিশ্বব্যাংকের দারিদ্র্য মূল্যায়ন তুলে ধরে তিনি বলেন, দেশে দরিদ্র ও নতুন দরিদ্র উভয় শ্রেণির সংখ্যাই বেড়েছে।
তিনি উল্লেখ করেন, পরিস্থিতি আরো খারাপ না হওয়ার তিনটি কারণ রয়েছে।
প্রথমত. দেশের সামাজিক রেজিলিয়েন্স অত্যন্ত শক্তিশালী-২০২৪ সালের ৫-৮ আগস্ট রাষ্ট্রীয় কাঠামো প্রায় অচল থাকলেও অর্থনীতি ভেঙে পড়েনি। দ্বিতীয়ত. অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা তুলনামূলক নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ তৈরি করেছে। ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকলেও ভাষার ভদ্রতা একটি সাংস্কৃতিক পরিবর্তন নির্দেশ করে। তৃতীয়ত. সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় অতীতের ‘আত্মঘাতী আচরণে’ এখন মন্দা চলছে, যা তার মতে ভালো লক্ষণ এবং স্থায়ী হওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, শুধু ইচ্ছা থাকলেই সংস্কার সম্ভব নয়। রাজনৈতিক স্ট্যামিনা না থাকলে সংস্কার মাঝপথে ‘হ্যাং’ হয়ে যায়।
এ সময় অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, মূল্যস্ফীতিকে ৫ শতাংশে নামাতে হলে সুদের হার আরো বাড়াতে হতে পারে। কারণ দেশের বিশাল অনানুষ্ঠানিক খাত নীতিগতভাবে কঠোর প্রয়োগ দাবি করে। তিনি জানান, মূল্যস্ফীতি কমে আসার কৃতিত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের হলেও লক্ষ্য অর্জনে উচ্চ সুদের পরিবেশ কিছুদিন বজায় রাখা প্রয়োজন।
প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের দুর্বলতা দূর না করলে ‘ম্যানুফ্যাকচারিং রেভল্যুশন’ সম্ভব নয়। তিনি অভিযোগ করেন, গণমাধ্যম কিছু ‘টিনি গ্রুপ’-এর মতামতকে অযথা প্রাধান্য দিয়ে যুক্তিগুলো হাইজ্যাক করেছে।
অন্যদিকে এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান জানান, এনবিআর বিলুপ্ত করে গঠিত ‘রাজস্ব নীতি’ ও ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা’ এই দুই বিভাগ ডিসেম্বরের মধ্যেই কার্যক্রম শুরু করবে। তিনি বলেন, নীতি প্রণয়ন এখন স্বাধীনভাবে করা যাবে, যা দেশের ও ব্যবসার স্বার্থে রাজস্ব বৃদ্ধি এবং বৈষম্য দূর করতে সহায়ক হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার সময় অর্থনীতি ছিল বহুমুখী চাপে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারের সংকট, রিজার্ভ হ্রাস, চলতি হিসাবে ঘাটতি এবং ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব। তিনি জানান, বিনিময় হার স্থিতিশীল করতে দুই দিনের মধ্যে দেশি-বিদেশি ব্যাংকারদের সঙ্গে বৈঠক করে নিশ্চয়তা দেওয়ায় বাণিজ্য অর্থায়ন স্বাভাবিক হয় এবং বর্তমানে পেমেন্ট ব্যালান্স পজিটিভ, রিজার্ভ ১৭ থেকে বেড়ে ২৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। তবে মূল্যস্ফীতি এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। টাকা ছাপানো ও বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রি বন্ধ রেখে বাজারকে নীতিনির্ভর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরো জানান, আর্থিক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে ৪০টি ব্যাংকের বোর্ড পরিবর্তন, প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৩৫.৬ শতাংশ প্রকাশ, লোকসানকারী ব্যাংকে বোনাস বন্ধ, মূলধন ঘাটতি না মেটা পর্যন্ত লভ্যাংশ নিষিদ্ধসহ কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।