বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ব্যবসা রাজনৈতিক সম্পর্ককে ‘প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট’ ধাঁচে রূপান্তরিত করে মন্তব্য করে বলেন, যদি ব্যবসায়ীকে টিকে থাকতে হয় বা তাঁকে উন্নতি করতে হয়, তবে তাঁদের সরকারকে সঙ্গে রাখতে হয়। তিনি গতকাল গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসের বার্ষিক সম্মেলনের সমাপনীতে ‘উন্নয়ন ও গণতন্ত্র’ বিষয়ক আলোচনায় এমন মন্তব্য করেন। এ সময় তিনি নির্বাচন ও প্রতীক দেখে ভোট দেওয়ার সংস্কৃতির সমালোচনা করে বলেন, ‘প্রতীক দেখে ভোট দিয়ে আমরা স্বৈরাচারী নেতৃত্বের জন্য পথ উন্মুক্ত করি।’
সম্মেলনে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানও বক্তব্য দেন। গভর্নর আরো বলেন, ‘গত ১৫ বছরে শিক্ষক সমিতি, ইনটেলেকচুয়াল গ্রুপ বা অন্যান্য বুদ্ধিজীবী মহলে কোনো কার্যকর আলোড়ন লক্ষ করা যায়নি। প্রতীকভিত্তিক ভোটের কারণে ’৯০-পরবর্তী গণতান্ত্রিক সময়েও ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে এবং অবৈধ প্রয়াসে ক্ষমতা রাখার প্রবণতা দেখা গেছে। শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করার ক্ষেত্রে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।’
তিনি উল্লেখ করেন, দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার অতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে একজন নেতাকে ছাড়া দেশ পরিচালনা করা যায় না, যা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও নীতি প্রণয়নে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।
রেহমান সোবহান বলেন, দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সংসদ কার্যকরভাবে সরকারের নীতিমালা, দুর্নীতি বা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ওপর জবাবদিহির মাধ্যম হতে পারেনি। ফলে সরকারকে তাদের অর্থনৈতিক নীতি, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বা দুর্নীতির জন্য জবাবদিহির মুখোমুখি আনার সুযোগ কখনোই হয়নি। আমরা কখনোই এমন একটি কার্যকর সংসদ পাইনি যেখানে শক্তিশালী বিরোধী দল উপস্থিত থাকত এবং পাঁচ বছর ধরে প্রয়োজনীয় সব বিষয়ে আলোচনা করে সরকারকে জবাবদিহির আওতায় আনত।
রেহমান সোবহান আরো বলেন, ‘আমাদের এখানে বড় যে সমস্যাটির মুখোমুখি হতে হয়েছে, তা হলো—আমাদের ‘অকার্যকর সংসদের’ উপস্থিতি।
বাজেটসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিরোধী দল প্রায়ই সংসদে অংশগ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে সরকারকে তাদের অর্থনৈতিক নীতি, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বা দুর্নীতির জন্য জবাবদিহির মুখোমুখি আনার সুযোগ কখনোই হয়নি।’ রেহমান সোবহান বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও উন্নয়নের মধ্যে সমন্বয় ব্যর্থতার কারণ হিসেবে সংসদের কার্যকারিতা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির ঘাটতি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের বেশির ভাগই অর্থ ও সম্পদ ব্যবহার করে নির্বাচিত হয়েছেন। ফলে সংসদ এক ধরনের ‘অভিজাতদের’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠেছে, যাঁরা প্রকৃতপক্ষে নীতিনির্ধারণ করছেন।
রাজনৈতিক সংস্কৃতির উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে বলেন, সেই সময় প্রার্থীরা সাধারণ পরিবহন ব্যবহার করতেন। আজকাল পাজেরো গাড়ি ছাড়া কেউ নির্বাচন করার সাহস পান না, আর নির্বাচিত হলে বিশেষ সুবিধা পাওয়ার আশা থাকে।