বাগেরহাটে এখন মাঠের পর মাঠ নেই অতীতের সেই সোনালি ধানের শিষ, মাঠে এখন ঢেউ তুলছে লবণাক্ত পানিতে চিংড়ি চাষের ঘের। গত এক দশকে উপকূলীয় এই জেলায় যে বদল এসেছে তা কয়েক কয়েক হাজার মানুষের এনে দিয়েছে বিপুল সমৃদ্ধি, তবে, লাখ লাখ কৃষকের জীবনে বয়ে এনেছে অস্থিরতা ও ক্ষতি।
জেলার রামপাল, মোংলা, মোরেলগঞ্জ, কচুয়া থেকে শুরু করে বাগেরহাট সদরে লবণাক্ততার কারনে হাজার হাজার হেক্টর চাষযোগ্য জমি রূপান্তরিত হয়েছে চিংড়ি চাষের ঘেরে। বড় বিনিয়োগকারীদের জন্য এ পরিবর্তন বৈদেশিক বাজারে চিংড়ি রপ্তানির সম্ভাবনা বাড়ালেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন লাখ লাখ কৃষক। বহু পরিবার জমি হারিয়ে, দেনার বোঝা বাড়িয়ে এবং চাষাবাদের অনুপযোগী মাটি নিয়ে এখন দিশেহারা।
মোরেলগঞ্জের হরতকিতলা গ্রামের কৃষক আতিয়ার রহমান জানান, আগে তাঁর সব জমিতেই ধান হতো। এখনমাত্র আড়াই একর ধান চাষ করেন, বাকি ৫ একরে প্রভাবশালীরা বাগদা চিংড়ির ঘের করছে। মোংলার চিলা গ্রামের কৃষক রতন হাওলাদার জানান, তাঁর পুরো ৫ একর জমিই এখন চিংড়ি চাষে ব্যবহৃত হয়, ধান চাষ আর করেন না। এই চিংড়ি ঘেরে লবণাক্ত পানি ঢুকানোর ফলে পাশের কৃষকের জমিতে আর ধান হচ্ছেনা। ধানের ফলন কমে যাওয়ায় অনেককে কম দামে জমি লিজ দিতে বাধ্য হতে হয়েছে।
গত বছর খুলনার মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) এবং বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের যৌথ জরিপে দেখাগেছে, বাগেরহাট জেলাটির বিভিন্ন অঞ্চলে মাটির লবণাক্ততা গত এক দশকে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। পশুর, দড়াটানা, পনগুছি ঘষিয়াখালী নদীর লবণাক্ততা শুষ্ক মৌসুমে প্রায় ২০ ডিসিএম পর্যায়ে উঠে যায়, যা ধানসহ অধিকাংশ ফসলের সহনক্ষমতার চেয়ে বহুগুণ বেশি।
বাগেরহাট ২০২০ সালে জেলার মোট কৃষিজমি ছিল ১ লাখ ৮৪ হাজার ৮৪১ হেক্টর। ২০২৪ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার ৮৬১ হেক্টরে। যদিও ফসল চক্রের অনুপাত জেলায় শতকরা ৬১ শতাংশ এক ফসলি, ২৭ শতাংশ দুই ফসলি, ১১ শতাংশ তিন ফসলি জমি। পানিতে লবণাক্ততা বাড়য় কৃষি জমিগুলো সহজেই চিংড়ি ঘরে পরিণত হচ্ছে।
ধরিত্রী রক্ষায় আমরা খুলনা বিভাগের সমন্বয়কারী শেখ নূর আলম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাগেরহাট জেলায় লবণাক্ততা বাড়ায় কৃষিতে ধস নামেছে। ৮০ দশকে চালু হওয়া চিংড়ি চাষ কৃষির পরিবেশ পুরোপুরি নষ্ট করে দিয়েছে। ধান ছাড়াও সবজি, কলা সবই লবণাক্ততায় আক্রান্ত হচ্ছে। এমনকি জনস্বাস্থ্যের ওপরও এর ক্ষতি পড়ছে। চিংড়ি রপ্তানি বছরে ৩ থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা আয় করলেও কৃষি, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যে এর ক্ষতির পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। তাই পরিকল্পনা ছাড়া চিংড়ি চাষ বন্ধে কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাগেরহাটে চিংড়ি চাষের জমি বেড়েছে। বাগদা চিংড়ি চাষ হচ্ছে ৫২ হাহার ৫৫১ হেক্টর জমিতে, উৎপাদন ২০ হাজার ৯৪০ মেট্রিক টন। আর গলদা চাষ হচ্ছে ১৯ হাহার ৭৭৩.৩ হেক্টর জমিতে। বাগদা উৎপাদন ১৯ হয়েছে ৭১৬.৩ মেট্রিক টন। এ হিসাবে চলতি অর্থবছরে চিংড়ি থেকে আয় হয়েছে ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। যা দেশের মোট চিংড়ি রপ্তানী আয়ের (গত অর্থবছরে ৪,০০০ কোটি টাকা) চেয়ে কিছুটা কম।
বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মতাহার হোসেন জানান, শিল্পায়ন, শহরায়ণ এবং নদীর লবণাক্ততা বৃদ্ধিই বাগেরহাট জেলায় চাষযোগ্য জমি কমে যাওয়ার মূল কারণ। নভেম্বর থেকেই নদীর পানিতে তীব্র লবণাক্ততা শুরু হয়, যা আগে জানুয়ারি মাসে হতো। মার্চ- এপ্রিল নাগাদ জমির ফসল লবনাক্ততায় মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমন পরিস্থিতিতে লবণ-সহনশীল ধান বীজের প্রচলন ও এক ফসলি জমিকে দুই ফসলি ব্যবস্থায় আনতে কাজ করছে কৃষি বিভাগ। এরমধ্যে প্রভাবশালীরা অনেক ক্ষেত্রেই কৃষকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে জমি চিংড়ি ঘেরের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে, যা সাময়িক লাভ দিলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা কৃষিসহ পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হবে। যা বাগেরহাটে এখনই দেখা যাচ্ছে।
বিডি প্রতিদিন/এএম