ঋণ জালিয়াতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গের মাধ্যমে ১ হাজার ৯৬৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে এস আলম গ্রুপ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহী ও জনতা ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ৩৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল সংস্থাটির চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ দুদকের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ সিরাজুল হক মামলাটি করেন। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে বেআইনিভাবে ঋণের সীমা অনুমোদন, ঋণের শর্ত লঙ্ঘন এবং অতিরিক্ত ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড দায় তৈরি করেছেন। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকটির বিপুল আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে। মামলার আসামিদের মধ্যে রয়েছেন- গ্লোবাল ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশেদুল আলম এবং কোম্পানির পরিচালক ফারজানা বেগম, মোহাম্মদ আবদুস সবুর, শহিদুল আলম, সাইফুল আলম ও ওসমান গনি।
এছাড়া অনিয়মে সহায়তার অভিযোগে দুই ইনস্পেকশন এক্সিকিউটিভ খন্দকার রবিউল হক ও খন্দকার জহিরুল হকের নামও এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। মামলায় জনতা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি), মহাব্যবস্থাপকসহ (জিএম) সাবেক ও বর্তমান অনেক কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন- ব্যাংকের সাবেক এমডি ও সিইও আবদুস ছালাম আজাদ, সাবেক চেয়ারম্যান এস এম মাহফুজুর রহমান এবং সাবেক জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কামরান আহসান, শহিদুল হক, মাশফিউল বারী, কামরুজ্জামান খান, আবদুল জব্বার, তাজুল ইসলাম ও ইসমাইল হোসেন। তারা ব্যাংকের কর্পোরেট, বিভাগীয় এবং প্রধান কার্যালয়ের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, আসামিরা ব্যাংকিং বিধি ও অভ্যন্তরীণ নির্দেশিকা লঙ্ঘন করে ঋণের সীমা অনুমোদন ও নবায়ন করেছেন। মার্জিন মানি সংগ্রহ না করেই এলটিআর (লেটার অব ট্রাস্ট রিসিপ্ট) ইস্যু করা হয়। প্রতিটি ট্রাস্ট রিসিপ্টের জন্য আলাদা চার্জ ডকুমেন্ট খোলা হয়নি এবং আমদানি করা পণ্য এলেই দেশে পৌঁছেছে কি না, তাও যাচাই করা হয়নি। তদন্তে উঠে এসেছে, বেশ কিছু ক্ষেত্রে গ্রাহকদের কাছ থেকে নন-জুডিশিয়াল অঙ্গীকারনামা নেওয়া হয়নি এবং গ্রাহকের গুদামে থাকা পণ্যের বিমা কাভারেজও নিশ্চিত করা হয়নি।
দুদক আরও অভিযোগ করে, ঋণগ্রহীতারা অনুমোদিত ঋণের শর্ত ভঙ্গ করে নিজস্ব ব্যবসায়িক গ্রুপের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পণ্য আমদানি করেছেন। এছাড়া বন্ধকি সম্পত্তির মূল্য বেশি দেখানো হয়েছে এবং অপর্যাপ্ত জামানতের বিপরীতে ঋণ ছাড় করা হয়েছে। ঋণের অর্থ গ্রুপ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পাচার ও স্থানান্তর (লেয়ারিং) করা হয়েছে। দুদক বলছে, ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড উভয় ক্ষেত্রেই এসব অনিয়ম করা হয়েছে। এর মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ও অননুমোদিত এলটিআর দায় সৃষ্টি এবং নির্ধারিত সময়ে অর্থ জমা না দেওয়ার বিষয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত।
এসব কর্মকাণ্ড পরিকল্পিত জালিয়াতি এবং ফিডুসিয়ারি বা বিশ্বাসজাত দায়িত্বের লঙ্ঘন। ২০১০ সাল থেকে শুরু হওয়া লেনদেনগুলোর ক্ষেত্রে এসব অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে। আর্থিক ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ ও অর্থের প্রবাহ শনাক্ত করতে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চলছে। সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ শেষ হলে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এর আগে গতবছরের ডিসেম্বরে এস আলম গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রায় ১ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের অভিযোগে মামলা করেছিল জনতা ব্যাংক। ওই ঘটনায় দেখা যায়, গত ১৪ বছরে এস আলম গ্রুপের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকটির কর্পোরেট শাখা থেকে প্রায় ৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যার খুব সামান্যই পরিশোধ করা হয়েছে।