ইউনেস্কো-ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বা বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষিত বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদটি এখন তীব্র লবণাক্ততায় অস্তিত্বসংকটে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, অতিরিক্ত লবণাক্ততা, আর্দ্রতা এবং পরিবেশগত দূষণের প্রভাবে মসজিদের দেয়াল, মিহরাব, স্তম্ভ ও গম্বুজে ক্ষয় দেখা দিয়েছে। দ্রুত ক্ষয়ের কারণে হজরত খানজাহান আলীর (রহ.) অমর সৃষ্টি ১৫ শতকে নির্মিত ঐতিহাসিক এ স্থাপনাটি এখন মারাত্মক ঝুঁকির মুখে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণা ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্টে ষাটগম্বুজ মসজিদে সংরক্ষণ ও সংস্কারকাজ দ্রুত শুরু না করা হলে মিহরাব যে কোনো সময় ভেঙে পড়ার ঝুঁকির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর মিহরাব ভেঙ্গে পড়লে ষাটগম্বুজ মসজিদের মূল কাঠামোও তখন অস্তিত্ব সংকটের ঝুঁকিতে পড়বে। প্রাচীন চুন-সুরকি, পোড়ামাটির ইট এবং বেলেপাথরের সমন্বয়ে তৈরি ষাটগম্বুজ মসজিদটি বর্তমানে অতিরিক্ত লবণাক্ততার শিকার। এতে নিচের দিক থেকে উঠে আসা নোনা পানি শুকিয়ে ইটের ভিতরে লবণ ক্রিস্টাল তৈরি করছে, যা ধীরে ধীরে ইটের বন্ধন দুর্বল করে দিচ্ছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী ১০টি মিহরাবের মধ্যে মাঝের প্রধানটিসহ দক্ষিণের পাঁচটি ও উত্তরের চারটি মিহরাব, অনেক স্তম্ভ ও গম্বুজ ক্ষয়ে যাচ্ছে। দ্রুত ক্ষয়ের কারণে দেয়ালজুড়ে সাদা লবণের স্তর, ফাটল, স্তর খসে পড়া ও লবণে মিহরাবগুলোর নকশা বিবর্ণ করে তুলেছে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর জানায়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিটেকচার ডিসিপ্লিন, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি ও আইকমসের যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, অতিরিক্ত তাপমাত্রা, শিল্প এলাকার কারণে বায়ুদূষণ, বর্ষায় আর্দ্রতা ও তীব্র লবণাক্ততার কারণে বিশ্ব ঐতিহ্য ষাটগম্বুজ মসজিদ স্থাপনাটির ক্ষয় বর্তমানে বহুগুণ বেড়েছে। এ যৌথ গবেষণা রিপোর্ট পাওয়ার পর প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ড. মো. শফিকুল আলমকে আহ্বায়ক ও অধিদপ্তরের প্রত্নতাত্ত্বিক রসায়নবিদ মোহাম্মদ আবুল হোসেনকে সদস্যসচিব করে পাঁচ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে।
কমিটির অন্য সদস্য বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. শেখ মুহাম্মদ নাজমুল ইমাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. বদরুদ্দোজা মিয়া এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের গঠিত কমিটির সদস্যরা ইতোমধ্যে সরেজমিন ষাটগম্বুজ মসজিদ পরিদর্শন শেষে তাঁদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। সেই প্রতিবেদনেও ষাটগম্বুজ মসজিদের প্রধানসহ ১০টি মেহরাব যে কোনো সময় ভেঙে পড়ার ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ড. মো. শফিকুল আলম জানান, ‘আমাদের কমিটির সদস্যরা ইতোমধ্যে সরেজমিন ষাটগম্বুজ মসজিদ পরিদর্শন করেছি। সুপারসাইক্লোন সিডর ও আইলার মতো সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে বায়ুতাড়িত লবণাক্ত পানি মসজিদটির মিহরাবগুলোতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। লবণাক্ততার সেই ক্ষত এখন আরও তীব্র হচ্ছে। দেয়ালের বেশ কয়েকটি অংশ মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততায় আক্রান্ত হয়েছে। ষাটগম্বুজ মসজিদটির মিহরাব ও স্তম্ভসমূহ বেলেপাথর দিয়ে নির্মিত। বেলেপাথর নরম ও ছিদ্রযুক্ত হওয়ায় সহজেই লবণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তীব্র লবণাক্ততার কারণে মিহরাবগুলোর নকশাও দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দুই পাশের স্তম্ভের ক্ষয়ে শূন্যতা তৈরি হয়েছে। পাথরখ গুলো ধরার জন্য ব্যবহৃত লোহার ক্ল্যাম্পও জং ধরে সংযোগ দুর্বল হয়ে গেছে। যার কারণে ওজন ধরে রাখার সক্ষমতা কমে যাওয়ায় যে কোনো সময় মিহরাবগুলো ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। মিহরাব ধসে পড়লে ষাটগম্বুজ মসজিদকে ইউনেস্কো বিপজ্জনক বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করতে পারে। তাহলে আমাদের জাতীয় মর্যাদার জন্য বড় আঘাত হবে। যে কারণে তদন্ত প্রতিবেদনে ষাটগম্বুজ মসজিদে দ্রুত সংরক্ষণ ও সংস্কারকাজ করতে ইউনেস্কোর সহায়তা চাওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।’ দ্রুত সংরক্ষণ ও সংস্কারকাজ না করা হলে ষাটগম্বুজ মসজিদের মূল কাঠামোও ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কার কথাও জানান তিনি।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন জানান, ‘দ্রুতই ষাটগম্বুজ মসজিদের প্রতিটি দেয়াল, গম্বুজ, মিহবার ও স্তম্ভের ক্ষয়চিত্র তৈরি করা হবে, যাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে ইউনেস্কোর সহায়তা নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করে ষাটগম্বুজ মসজিদের সংরক্ষণ কার্যক্রম শুরু করা যায়। এ ছাড়া তদন্ত প্রতিবেদনে ইউনেস্কোর ঢাকা অফিসের পরামর্শ নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে ষাটগম্বুজ মসজিদে সাময়িক সংরক্ষণকাজ শুরুর কথা বলা হয়েছে। প্রয়োজনে বুয়েটের অভিজ্ঞ স্ট্রাকচার ইঞ্জিনিয়ারদের সহায়তা নিতে হবে।’ তবে পাথরের স্থাপনা সংরক্ষণে দেশে দক্ষ জনবল না থাকায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য বলে জানান তিনি।