কুমিল্লা-৯ (লাকসাম-মনোহরগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও লাকসাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাইফুল ইসলাম হিরু এবং পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবির পারভেজ গুমের গতকাল এক যুগ পূর্ণ হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর তারা গুমের শিকার হন। হিরু-হুমায়ুনের পথ চেয়ে আছে পরিবার-পরিজন, লাকসাম-মনোহরগঞ্জের বিএনপিপ্রেমীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। এক যুগেও তাদের সন্ধান মেলেনি।
ভিকটিমের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির টানা অবরোধ চলাকালে ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর রাত ৯টায় লাকসামে বিশেষ অভিযান চালায় র্যাব-পুলিশসহ যৌথ বাহিনীর সদস্যরা। একপর্যায়ে র্যাবের সদস্যরা উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরুর মালিকানাধীন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ‘লাকসাম ফ্লাওয়ার মিলে’ প্রায় এক ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে নয়জনকে গ্রেপ্তার করে। এ খবর পেয়ে রাতেই সাইফুল ইসলাম হিরু, পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবির পারভেজ এবং একই কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক জসিম উদ্দিন একটি অ্যাম্বুলেন্সে লাকসাম থেকে কুমিল্লার উদ্দেশে রওনা করেন। তাদের বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সটি কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কের আলীশ্বর এলাকায় পৌঁছলে সাদা পোশাকধারী একদল লোক সেটি গতিরোধ করে। পরে গতিরোধকারীরা নিজেদের র্যাব পরিচয়ে দিয়ে তাদের আটক করে অন্য একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে কুমিল্লার দিকে নিয়ে যায়। ওইদিন রাত সাড়ে ১২টার দিকে জসিম উদ্দিন (অ্যাম্বুলেন্সে থাকা) এবং লাকসামে গ্রেপ্তার নয়জনকে থানায় হস্তান্তর করেন র্যাব-১১ এর কুমিল্লা শাখার তৎকালীন ডিএডি শাহজাহান আলী। পরদিন সকালে তাদের জেলহাজতে পাঠায় পুলিশ। এতে জসিম রক্ষা পেলেও শেষরক্ষা হয়নি বিএনপি নেতা হিরু ও হুমায়ুনের। চাঞ্চল্যকর গুমের ঘটনায় ২০১৪ সালের ১৮ মে হুমায়ুন কবির পারভেজের বৃদ্ধ পিতা রগু মিয়া বাদী হয়ে অপহরণের পর গুমের অভিযোগ এনে কুমিল্লার আদালতে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় র্যাব-১১ এর বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া সাবেক অধিনায়ক (সিইও) ও নারায়ণগঞ্জের সাত খুনে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, র্যাব ১১-এর তৎকালীন কুমিল্লা ক্যাম্পের কোম্পানি-২ এর মেজর শাহেদ হাসান রাজীব, উপসহকারী পরিচালক মো. শাহজাহান আলী, উপপরিদর্শক কাজী সুলতান আহমেদ ও অসিত কুমার রায়কে অভিযুক্ত করা হয়।
ওইদিন আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য লাকসাম থানার ওসি নির্দেশ দেন। মামলার প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন কয়েক দফা সময় নিয়ে ২০১৪ সালের ১৫ অক্টোবর আদালতে দাখিল করে লাকসাম থানা পুলিশ। এতে পুলিশ উল্লেখ করে র্যাব দুই ভিকটিমকে অপহরণ করেছে বলে মামলার সাক্ষীরা বক্তব্য দিলেও প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণে তার সত্যতা পাওয়া যায়নি। তবে অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারীদের মাধ্যমে তারা অপহৃত হতে পারেন। ওই সময়ে পুলিশের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি দিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান মামলার বাদী।
পরে বাদীপক্ষের নারাজি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি আদালত মামলাটি সিআইডিকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। দীর্ঘ পাঁচ বছরের বেশি সময় নিয়ে ২০২০ সালের ২৭ আগস্ট মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি, কুমিল্লার অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জালাল উদ্দিন আহম্মদ তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেন। এতে র্যাব দুজনকে অপহরণের বিষয়টি প্রমাণিত হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়। চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি গুম হওয়া হুমায়ুন কবির পারভেজের ছোট ভাই গোলাম ফারুক বাদী হয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা করেছেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ও কুমিল্লা-৯ (লাকসাম-মনোহরগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মো. তাজুল ইসলামকে। এ ছাড়া র্যাবের সাবেক অধিনায়ক (সিইও) লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, কুমিল্লা ক্যাম্পের কম্পানি-২ এর মেজর শাহেদ হাসান রাজীব, উপসহকারী পরিচালক মো. শাহজাহান আলী, উপপরিদর্শক কাজী সুলতান আহমেদ ও অসিত কুমার রায় ও লাকসাম থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল খায়েরকে আসামি করা হয়।