রাজধানীর সরকারি সাত কলেজ নিয়ে সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি গঠনের উদ্যোগের পর থেকেই অসন্তোষ শুরু হয়েছে বিভিন্ন মহলে। অসন্তোষ যেমন রয়েছে ছাত্রছাত্রীদের পক্ষ থেকে, তেমনি অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন এসব কলেজে কর্মরত শিক্ষক তথা শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারাও। এ উদ্যোগে বড় প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন মহিলা দুই কলেজের (ইডেন মহিলা কলেজ ও বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ) ছাত্রীরা। তারা বলছেন, নারীশিক্ষা বিস্তারণ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি হলেও এসব কলেজ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ দেওয়া হলে বড় পরিসরে নারীশিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, এসব কলেজে এখন শুধু ছাত্রীদের পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হলে এগুলোতে সহশিক্ষা কার্যক্রম চালু হবে। ফলে নারী স্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র্য এসব কলেজে ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন হবে।
সাতটি সরকারি কলেজে প্রায় সাড়ে ১২ শ শিক্ষা ক্যাডারের পদ রয়েছে। শিক্ষা ক্যাডাররা মনে করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ দেওয়া হলে এ বিপুলসংখ্যক শিক্ষা ক্যাডারের পদ বিলুপ্ত হবে। তাই শিক্ষা ক্যাডাররাও এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। তারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ দেওয়া হলে কলেজগুলোর স্বতন্ত্র কাঠামো ও ঐতিহ্য বিলুপ্ত হবে। ইডেন মহিলা কলেজ ও বেগম বদরুন্নেসা কলেজ বহু বছর ধরে নারীদের জন্য নিরাপদ ও সাশ্রয়ী উচ্চশিক্ষার সুযোগ প্রদান করে আসছে, এটিও ক্ষুণ্ন হওয়ার শঙ্কা তাদের। শিক্ষকরা বলছেন, প্রস্তাবিত কাঠামোয় নারী শিক্ষার ব্যাপক সংকোচনের পরিকল্পনাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
সম্প্রতি রাজধানীর এই সাতটি কলেজে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে সম্মান প্রথম শ্রেণিতে ৯ হাজার ৩৮৮ শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সেশনের শিক্ষার্থীদের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হলেও এই ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাজীবনে অনিশ্চয়তা নেমে এসেছে। কারণ, কোনো কলেজেই শিক্ষকরা তাদের পাঠদান শুরু করেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কোনো কোনো শিক্ষক বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের ঘোষণা জেনে ছাত্রছাত্রীরা কলেজ শিক্ষকদের কাছে আর পাঠ গ্রহণে আগ্রহী নয়, এটিও তাদের ক্লাস শুরু না হওয়ার বড় কারণ।
সাতটি কলেজকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় রূপ দেওয়ার উদ্যোগের পর থেকে চলছে বিভিন্ন পক্ষের আন্দোলন বিক্ষোভ। ইডেন মহিলা কলেজের মাস্টার্সের ছাত্রী ইকরা জাহাঙ্গীর বলেন, সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি করা নিয়ে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে ইডেন কলেজে সহশিক্ষা কার্যক্রম শুরু হলে আমাদের আপত্তি আছে। কারণ এ কলেজ ও বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ মেয়েদের জন্য বিশেষায়িত। আমরা চাই শুধু মেয়ে শিক্ষার্থীদের এসব ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করার সুযোগ থাকবে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের খসড়ায় বলা হয়েছে ইডেন ক্যাম্পাসে স্কুল অব সায়েন্সের অধীনে বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান করা হবে। এটি বাস্তবায়ন করা হলে অনেক বিষয় বিলুপ্ত হবে। এ কলেজে নতুন বিষয় খোলা হলে তা নিয়ে আমাদের আপত্তি নেই, কিন্তু কোনো বিষয় বাদ দেওয়া যাবে না। এসব দাবি নিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষা সচিব বরাবর লিখিত চিঠি দিয়েছেন বলেও জানান এ ছাত্রী।
শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব মো. শওকত হোসেন গতকাল এ প্রতিবেদককে বলেন, কোনো প্রকার সমীক্ষা বা গবেষণা ছাড়াই সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যার কারণে নানা সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। সাত কলেজের স্বতন্ত্র নিয়ে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যে যেমন অসন্তোষ রয়েছে, শিক্ষার্থীরাও তেমনি দুই ভাগে ভাগ হয়ে পরস্পর বিরোধী অবস্থানে চলে গেছে। এটি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য খুবই অশনিসংকেত। এ শিক্ষক নেতা মনে করেন, সব পক্ষের সঙ্গে কার্যকর আলোচনার মাধ্যমে এ সংকটের সমাধান করা উচিত।
সাত কলেজ স্বাতন্ত্র্য রক্ষা পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক মাহফিল আরা বেগম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এসব কলেজ পরিচালনার জন্য একটি প্রশাসনিক বডি থাকতে পারে বা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এফিলিয়েশন হতে পারে। তাহলে কলেজগুলোর স্বাতন্ত্র্য ও ঐতিহ্য রক্ষা হবে। কিন্তু প্রতিটি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একেকটি ক্যাম্পাসে রূপ দেওয়া হলে কলেজগুলো ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্র্য হারাবে। তিনি বলেন, শুধু ইডেন কলেজ থেকেই ২১টি সাবজেট বিলুপ্ত হয়ে যাবে, যা দুঃখজনক। তিনি বলেন, আমরা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকতে চাই তবে সাতটি কলেজের স্বাতন্ত্র্য বিলীন করে নয়।
একটি কলেজের অধ্যক্ষ বলেন, সাত কলেজ নিয়ে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় করা হলে সেখানে নতুন করে হাজার হাজার নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন করা হবে। শিক্ষা ক্যাডাররা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষা ক্যাডার হিসেবে সরকারি কলেজগুলোতে নিয়োগ পেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া হবে তদবির আর বাণিজ্যের মাধ্যমেই। তাই একটি পক্ষ মুখিয়ে আছে এ বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে রমরমা নিয়োগবাণিজ্য করতে। তিনি আরও বলেন, রাজধানীর বেশ কয়েকটি কলেজে বড় পরিসরে উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। অন্তর্বর্তী সময়ে একাদশে শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ রাখা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর হলে ভবিষ্যতে এসব ক্যাম্পাসে একাদশে শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ বিলীন হবে।
ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির প্রশাসক ও ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক এ কে এম ইলিয়াস বলেন, যেসব কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় চালু রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ দেওয়ার পরও সেগুলোতে স্থায়ীভাবে একাদশে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে। তিনি বলেন, ক্যাম্পাসগুলোতে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদ সংরক্ষণের বিষয়ে সরকার ভাবছে। সব পক্ষই বিশ্ববিদ্যালয় চায়, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেল কেমন হবে তা নিয়ে অনেকের মতভেদ রয়েছে। আগামী ২৫ ডিসেম্বর এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশের খসড়া চূড়ান্ত হবে। সেখানে এসব সমস্যার সমাধান মিলবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।
গতকাল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের যৌক্তিক চাহিদা পূরণের লক্ষ্যকে সামনে রেখে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার কাজ করে যাচ্ছে। আগামী ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু করা সম্ভব হবে। কলেজগুলোর স্বাতন্ত্র্য রক্ষা, নারী শিক্ষার সুযোগ সংকোচন না করা, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিতে কলেজসমূহের মালিকানা সংরক্ষণ, কলেজসমূহের বিদ্যমান মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত না করা, সর্বোপরি প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির সঙ্গে সাত কলেজের সম্পৃক্ততার ধরন বিষয়ে বাস্তবসম্মত, কার্যকর ও উপযোগী কাঠামো নির্ধারণসহ সব সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষযয়কে বিবেচনায় নিয়ে বস্তুনিষ্ঠভাবে ও বিধিবদ্ধ পদ্ধতি অনুসরণ করে অধ্যাদেশের খসড়া পরিমার্জন করা হচ্ছে।