ডিজিএফআইয়ের জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে (জেআইসি) আটকে নির্যাতনের ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আর্জি জানিয়েছে প্রসিকিউশন।
গতকাল বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম এ আর্জি জানান। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ এ মামলায় মোট আসামি ১৩ জন। এর মধ্যে শেখ হাসিনা ছাড়া সবাই সেনাবাহিনীর সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা।
আসামিদের বিরুদ্ধে গুমের মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। এদিন অভিযোগ গঠনের বিষয়ে প্রসিকিউশনের শুনানি শেষে আসামিপক্ষের শুনানির জন্য ৯ ডিসেম্বর দিন রেখেছেন ট্রাইব্যুনাল।
শুনানিতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ তুলে ধরে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ষড়যন্ত্রমূলক, নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের মাধ্যমে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী ও নিষ্কণ্টক করতে বিভিন্ন ধরনের অপকৌশলের আশ্রয় নেয়। প্রতিপক্ষদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে ব্যাপক মাত্রায়, পদ্ধতিগত এবং লক্ষ্যভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে। যার অন্যতম ছিল অপহরণ, আটক, নির্যাতন এবং বলপূর্বক গুম। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনামলে সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই)-সহ বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে গুম করা হতো। ২০১৫ সালের ২২ অক্টোবর থেকে গত বছর ৯ আগস্ট পর্যন্ত কমপক্ষে ২৬ জনকে অপহরণ করে গুম করা হয়। এসব ব্যক্তিকে গুম করার সিদ্ধান্ত এসেছিল সরাসরি শেখ হাসিনার কাছ থেকে। আর তা বাস্তবায়ন করেন তার সামরিক ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক। এদিকে জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের সময় কুষ্টিয়ায় ছয় হত্যাসহ আট অভিযোগের দায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ অব্যাহত রয়েছে। গতকাল বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ তদন্ত সংস্থার রেকর্ড শাখায় কর্মরত পুলিশের এসআই কামরুল ইসলাম জব্দ তালিকার সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন। পরে তাকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। এ মামলার পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আজকের দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
জেআইসিতে গুম করে নির্যাতনের ঘটনায় করা মামলায় শেখ হাসিনা ও তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ ১০ আসামিই পলাতক। তারা হলেন ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ও অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. আকবর হোসেন, ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মো. সাইফুল আবেদিন, ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ও অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. সাইফুল আলম, ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ও অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ তাবরেজ শামস চৌধুরী, ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল হামিদুল হক, ডিজিএফআইয়ের সিটিআইবির সাবেক পরিচালক ও সাবেক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ তৌহিদুল উল ইসলাম, ডিজিএফআইয়ের সিটিআইবির সাবেক পরিচালক ও মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদ এবং অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল মখছুরুল হক।
ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা তিন আসামি হলেন- ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক (সিটিআইবি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান সিদ্দিক, সাবেক পরিচালক (সিটিআইবি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভীর মাজাহার সিদ্দিক ও সাবেক পরিচালক (সিটিআইবি) মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন। অভিযোগ গঠন শুনানিকে কেন্দ্র করে গতকাল তাদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। শুনানির সময় তাদের আসামির কাঠগড়ায় তোলা হয়।
জেআইসির ভূমিকা তুলে ধরে চিফ প্রসিকিউটর শুনানিতে বলেন, এ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, ভিন্ন মতাবলম্বী এবং ক্ষমতার জন্য হুমকি বিবেচিত ব্যক্তিকে টার্গেট করে অত্যন্ত সুকৌশলে র্যাব, ডিবি বা এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের মাধ্যমে তাদের আটক করে জেআইসিতে আনা হতো। সেখানে তাদের দিনের পর দিন চোখ বেঁধে রাখা হতো, তাদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হতো। আটক হওয়া ব্যক্তিদের নিকটাত্মীয় বা ঘনিষ্ঠজনরা স্থানীয় থানায় অভিযোগ দায়ের করতে গেলে অভিযোগ নেওয়া হতো না। অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমীসহ ২৬ জনের নাম উল্লেখ করে তাজুল ইসলাম আরও বলেন, উল্লিখিত ব্যক্তিদের আটক ও গুম করার সিদ্ধান্ত আসত সরাসরি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে। আর আসামি তারিক আহমেদ সিদ্দিকের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে থেকে আসামি মখছুরুল হক মাঠপর্যায়ে গুমের শিকার ব্যক্তিদের চিহ্নিত করেছিলেন। এ ২৬ জনকে অবৈধভাবে আটক করে ডিজিএফআইয়ের অধীনস্থ জেআইসিতে অর্থাৎ আয়নাঘর নামক বন্দিশালায় গুম করে রেখে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে আসামিরা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন-১৯৭৩ এর বিভিন্ন ধারায় মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন বলে প্রাথমিকভাবে প্রমাণ মিলেছে, যা এ আইনের ২০(২) ও ২০ক ধারায় শাস্তিযোগ্য। ফলে আসামিদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হোক।