১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রামের পূর্ব পাহাড়তলীর বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয় অন্তত ৫ হাজার বাঙালিকে। এটিই চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি। ১০ নভেম্বর এক দিনেই সেখানে হত্যা করা হয় ১২৪ নিরীহ মানুষকে। পরে এটি জল্লাদখানা নামে পরিচিতি পায়।
পাশেই টিঅ্যান্ডটির রেস্ট হাউসে পাকিস্তানি বাহিনীর ধর্ষণের শিকার হয়েছেন শত শত নারী। নগরের দক্ষিণ কাট্টলির নাথপাড়া বধ্যভূমিতে ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ হত্যা করা হয় ৪২ জনকে। হালিশহর মধ্যম নাথপাড়ার গণচিতায় ৪৫ জন নরনারীকে পুড়িয়ে মারার বধ্যভূমির অবস্থাও বেহাল। এসব স্থান সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। চট্টগ্রামের বধ্যভূমিগুলো অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। কোথাও অরক্ষিত, কোথাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের শেষ স্মৃতিটুকু। আবার কোথাও বধ্যভূমির স্থানে ফেলা হচ্ছে বর্জ্য। জানা যায়, চট্টগ্রাম মহানগরে কয়টি বধ্যভূমি আছে তার নির্ভরযোগ্য তথ্যভিত্তিক কোনো সংখ্যা পাওয়া যায় না। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন বলছে, ৬১টি। এর মধ্যে ৫৮টির স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে পাওয়া না। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণাকেন্দ্র ট্রাস্ট বলছে, ১০০টি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সমাজতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মুক্তিযোদ্ধা ড. গাজী সালেহ উদ্দিন রচিত ‘প্রামাণ্য দলিল : মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ বইতে চট্টগ্রাম নগরে ৭৭টি বধ্যভূমির কথা উল্লেখ আছে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম মহানগর ইউনিট কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা ফাহিম উদ্দিন বলেন, বছরের কয়েকটি দিনে বধ্যভূমির কথা স্মরণ করা হলেও সারা বছর কেউ খবর রাখে না। ফলে অযত্ন, অবহেলায় বধ্যভূমিগুলো নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ট্রাস্ট চট্টগ্রামের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, নগরে প্রায় ১০০টি বধ্যভূমি থাকলেও কোনোটিই এখন পর্যন্ত রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ নগরের চেরাগী পাহাড় মোড় দিয়ে বাঙালি সৈনিকদের জন্য রসদ নিয়ে যাওয়ার পথে চট্টগ্রামের চার তরুণ পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়েন। এতে ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান তিনজন, আহত অন্যজন মারা যান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (চমেক)। একাত্তরের প্রতিরোধ যুদ্ধের সক্রিয় এই চার তরুণ হলেন- বশরুজ্জামান চৌধুরী, জাফর আহমদ, দীপক বড়ুয়া ও মাহবুবুল আলম চৌধুরী। ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ বইয়ের তথ্য মতে, তারাই মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামে প্রথম শহীদ। তবে মাহবুবুল আলম ছাড়া অন্যদের লাশ পাওয়া যায়নি। তখন মাহবুবুল আলম চৌধুরীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আহত হয়ে আসা ইপিআরের (বর্তমান বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) সদস্য ও ২০-২৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে মাটিচাপা দেওয়া হয় চমেক হাসপাতালের দক্ষিণ-পূর্ব পাশের পাহাড়ি জঙ্গলে। ২০০৮ সালে চমেকের এক শিক্ষার্থীর সহায়তায় এ গণকবরের ইতিহাস সামনে আসে। কিন্তু এটি এখনো অবহেলায়। চট্টগ্রাম নগরের বধ্যভূমির মধ্যে আছে- পাহাড়তলীতে ১৫টি, লালখান বাজারে ছয়টি, হালিশহরে পাঁচটি, গোসাইলডাঙ্গায় পাঁচটি, আন্দরকিল্লায় চারটি, বাকলিয়ায় তিনটি, রহমতগঞ্জে দুটি, কাট্টলীতে দুটি, পতেঙ্গায় দুটি, বন্দর এলাকায় দুটি, কাটগড়ে দুটি, মুরাদপুরে দুটি, নাসিরাবাদে দুটি, মাদারবাড়িতে দুটি, পাঁচলাইশে দুটি এবং চন্দনপুরা, জয়পাহাড়, চান্দগাঁও, ষোলোশহর, রামপুরায় একটি।
এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য বধ্যভূমির মধ্যে আছে- মহামায়া ডালিম হোটেল বধ্যভূমি, গুডসহিল বধ্যভূমি, পূর্ব পাহাড়তলী বধ্যভূমি, পশ্চিম পাহাড়তলী বধ্যভূমি, দক্ষিণ বাকলিয়া মোজাহের উলুম মাদ্রাসা বধ্যভূমি, চাক্তাই খালপাড় বধ্যভূমি, চামড়ার গুদাম চাক্তাই খাল পাড় বধ্যভূমি, তুলশী ধাম সেবায়েত মন্দির বধ্যভূমি, হাইওয়ে প্লাজা ভবন বধ্যভূমি, বাটালী পাহাড়ের রেলওয়ে বাংলো বধ্যভূমি, পাঁচলাইশ সড়কের আল বদর বাহিনী ক্যাম্প বধ্যভূমি, চট্টগ্রাম জেনারেল পোস্ট অফিস বধ্যভূমি, সিআরবি নির্যাতন কেন্দ্র বধ্যভূমি, চন্দনপুরা রাজাকার ক্যাম্প বধ্যভূমি, চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামের পাশের সেনাক্যাম্প বধ্যভূমি, সার্কিট হাউস বধ্যভূমি, বন্দর আর্মি ক্যাম্প বধ্যভূমি, রেলওয়ে ওয়ার্কশপ বধ্যভূমি, প্রবর্তক সংঘের পাহাড় বধ্যভূমি, সদরঘাট রাজাকার ক্যাম্প বধ্যভূমি, ঝাউতলা বিহারি কলোনি বধ্যভূমি ও সিভিল গোডাউন বধ্যভূমি।