গণ অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নড়বড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি গত ১৬ মাসেও ঠিক হয়নি। খুন, ধর্ষণ, গণপিটুনিতে হত্যা, অপহরণ, রাজনৈতিক হত্যা চলছেই। আইন হাতে তুলে নিচ্ছে মানুষ। রাস্তাঘাটে পড়ে থাকছে অজ্ঞাতনামা লাশ। অনিরাপদ হয়ে উঠেছে আদালতপাড়াও।
গতকালও খুলনা মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলার হাজিরা দিতে এসে দিনদুপুরে খুন হয়েছেন দুই ব্যক্তি। আদালতের প্রধান ফটকের বাইরে সবার সামনে গুলির পর চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। গত ১০ নভেম্বর মামলার হাজিরা দিয়ে বের হওয়ার সময় ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের ফটকের বিপরীতে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে। এমন পরিস্থিতিতে জনমনে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। গত ১৫ মাসে শুধু চট্টগ্রামে খুন হয়েছেন অন্তত ৩৫ জন। এর মধ্যে ২২ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আটজনকে খুনের আগে হুমকি দেওয়া হয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, হঠাৎ করে আন্ডারওয়ার্ল্ড সক্রিয় হয়ে উঠেছে। চট্টগ্রামে এসব খুনের নির্দেশনা ভারতে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলী খান ওরফে বড় সাজ্জাদের কাছ থেকে আসে বলে তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) তথ্য বলছে, গত অক্টোবরের চেয়ে নভেম্বরে গণপিটুনিতে হত্যা, রাজনৈতিক সহিংসতা, যৌন নিপীড়ন, নারী-শিশুর ওপর শারীরিক নির্যাতন, এসিড নিক্ষেপ, আত্মহত্যাসহ বেশ কিছু সূচকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এ ছাড়া খুন, অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর দুষ্কৃতকারীদের হামলা, ধর্ষণ, কারা হেফাজতে মৃত্যু, অপহরণের ঘটনাও উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। বাড়ছে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার ঘটনা। ১৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় মিরপুরে দোকানে ঢুকে যুবদল নেতা গোলাম কিবরিয়াকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ১৩ নভেম্বর চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় গুলি করে হত্যা করা হয় শ্রমিক দলের নেতা আবদুল মান্নানকে। ৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর গণসংযোগে গুলির ঘটনায় সরওয়ার নামে একজনের মৃত্যু হয়। ২৭ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মধ্যরাতে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় ছাত্রদলের সাবেক নেতা সাদ্দামকে। ১৫ নভেম্বর লক্ষ্মীপুরে আবুল কালাম নামে ওয়ার্ড বিএনপির এক নেতাকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। ২ নভেম্বর খুলনায় কুয়েট আইটি গেট-সংলগ্ন বিএনপি কার্যালয়ে গুলির ঘটনা ঘটে। এতে ইমদাদুল হক নামে এক শিক্ষকের মৃত্যু হয়।
এমএসএফ-এর তথ্যমতে, গত মাসে কারা হেফাজতে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে আরও দুজন প্রাণ হারান। ৫৮টি অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে। ১১টি প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। আগের মাসে এই সংখ্যা ছিল একটি। ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৬১ জন নারী ও শিশু। গণধর্ষণের শিকার ১১ জন নারী ও শিশু। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় তিনজনকে। ধর্ষণ চেষ্টা করা হয় ২৭ জনকে। যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ২৮ জন। নানা কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৩৮ নারী ও শিশু। খুন হয়েছেন আরও ৭৩ নারী। অপহরণ ও নিখোঁজ হয়েছেন ১২ নারী ও শিশু। ১১টি নবজাতক উদ্ধার হয়েছে। গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ১৯ জন, আহত ৩৮ জন। আগের মাসে গণপিটুনিতে মারা যান ১২ জন, আহত হন ৫২ জন। এ ছাড়া রাজনৈতিক সহিংসতায় ৭২৭ জন আহত ও ১৩ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে দুষ্কৃতকারীদের হামলায় নিহত হয়েছেন চারজন, আহত হয়েছেন তিনজন। সীমান্ত পরিস্থিতি খুবই নাজুক অবস্থা। গত মাসে সীমান্তে দুজন নিহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন আরও চারজন। ১০৮ জন বাংলাদেশি নাগরিককে ধরে নিয়ে গেছে ভারতীয় কোস্ট গার্ড। আগের মাসে এই সংখ্যা ছিল মাত্র একজন। এ ছাড়া মিয়ানমারের আরাকান আর্মি ধরে নিয়ে গেছে ৪৭ জনকে, যা আগের মাসে ছিল মাত্র তিনজন। এ ছাড়া গত মাসে মানবতাবিরোধী অপরাধের রায়কে কেন্দ্র করে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ কর্তৃক অনলাইনে দেশব্যাপী শাটডাউন কর্মসূচি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৫২টি ককটেল বিস্ফোরণ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এতে একজন নারীসহ দুজন পুড়ে মারা যান। পোড়ানো হয় ৩২টি বাস, পাঁচটি মাইক্রোবাস, তিনটি অ্যাম্বুলেন্স ও ৩০টি অন্যান্য গাড়ি।