আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে আছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার যন্ত্রপাতির ক্রয়প্রক্রিয়া। মন্ত্রণালয়ের আওতায় ২০০৬ থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত তিন মেয়াদে এসব যন্ত্রপাতি ক্রয়ে প্রকল্প নেওয়া হয়। অনেক যন্ত্রপাতি পুরোনো হওয়ায় নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু কেনা হলেও এখনো অনেক যন্ত্রপাতি নানান বিধিনিষেধের কারণে কেনার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। ২ হাজার ২৭৫ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হলেও অন্তর্বর্তী সরকার এটিকে কমিয়ে ১ হাজার ৮৫১ কোটি টাকায় নিয়ে আসে। দায়িত্বপ্রাপ্তরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকারের ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার যন্ত্রপাতি যা আছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। ভূমিকম্প-পরবর্তী দুর্যোগ সামালানোর সক্ষমতাও এ মুহুর্তে সরকারের নেই।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকম্পের উদ্ধার অভিযান পরিচালনা প্রকল্পের (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্প পরিচালক ও যুগ্ম সচিব কাজী শফিকুল আলম গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর তৃতীয় পর্যায়ে ভূমিকম্প ও দুর্যোগের জন্য ২৪৭ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীর জন্য ৪০০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনার প্রক্রিয়া চলছে। কিছু টেন্ডার হয়ে গেছে আর কিছু চলমান। ডাম্প ট্রাক, এক্সকেভেটর, হ্যামার, ফর্ক লিফটের মতো ভারী যন্ত্রপাতি কেনা হবে। ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধারের জন্য এসব যন্ত্রপাতি লাগবে। যন্ত্রপাতি যা আছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। ভূমিকম্প-পরবর্তী দুর্যোগ সামালানোর সক্ষমতাও নেই। লজিস্টিক সাপোর্টও নেই। তিনি বলেন, পুরোনো যন্ত্রপাতিগুলোর মধ্যে যেগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ কিন্তু ঠিক করা যাবে সেগুলো ব্যবহার করা হবে। কিন্তু ভারী যন্ত্রপাতিগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হলে আর কাজ করে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকম্প ও অন্যান্য দুর্যোগকালে অনুসন্ধান, উদ্ধার অভিযান পরিচালনা এবং জরুরি যোগাযোগের জন্য যন্ত্রপাতি সংগ্রহ প্রকল্পের আওতায় ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার অভিযানের জন্য যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে যন্ত্রপাতি ক্রয়প্রক্রিয়া চলছে। প্রকল্পের মেয়াদ প্রথম পর্যায় ২০০৬ থেকে ২০১০, দ্বিতীয় পর্যায় ২০১৩ থেকে ২০১৭ এবং তৃতীয় পর্যায় ২০২০ থেকে ২০২৭ পর্যন্ত। এর আওতায় অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জামাদি, তাঁবু, এয়ার বোট, ইমারজেন্সি রেসপন্স ভেহিক্যাল, সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ ইকুইপমেন্ট এবং টেলিযোগাযোগ সরঞ্জামাদি ক্রয় করার কথা।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, উদ্ধার যন্ত্রপাতি ক্রয়ের গতি আরও বাড়লে ভালো হতো। সাধারণত এসব যন্ত্রপাতি ক্রয় বেশ সময়সাপেক্ষ। অনেক নিয়মকানুন মানতে হয়। একটি যন্ত্র ক্রয়ে কমপক্ষে ছয় মাস চলে যায়। এগুলো ভারী ও বিশেষায়িত যন্ত্র। বাংলাদেশে পাওয়া যায় না। বাইরে থেকে কিনতে হয়। দরদামও করতে হয়। দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কমিটি এ বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে। টেন্ডার করার সময় অনেকের অভিযোগের কারণে কার্যক্রম পিছিয়ে যায়। তাঁরা আরও জানান, প্রকল্পের আওতায় প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে কেনা অনেক যন্ত্রপাতি অনেক দিন হয়ে যাওয়ায় নষ্ট হয়ে যাবে- এটাই স্বাভাবিক। দুর্যোগের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ১০টি প্রতিষ্ঠানকে এই যন্ত্রপাতিগুলো দেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে ১১টি ল্যাডার ফায়ার সার্ভিসকে দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া হেলমেট, লাইফ জ্যাকেটের মতো আরও অনেক যন্ত্রপাতি দেওয়া হয়েছে। উদ্ধার কার্যক্রমে পাইলট প্রকল্প হিসেবে ড্রোন ও রোবট ব্যবহার করার কথা চিন্তাভাবনা করছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটি প্রথমে ছিল ২ হাজার ২৭৫ কোটি টাকার। অন্তর্বর্তী সরকার এটিকে কমিয়ে ১ হাজার ৮৫১ কোটি টাকায় নিয়ে আসে। এর জন্য ফায়ার সার্ভিসকে সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা দেওয়া আছে। সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া আছে। এই যন্ত্রপাতি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, আর্মড ফোর্সেস ডিভিশন, নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড, পুলিশ, র্যাব, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, রেড ক্রিসেন্ট ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-এর উদ্ধারকাজে ব্যবহারের জন্য বিতরণ করা হবে।
এই প্রকল্পের প্রথম পর্যায় ২০০৬ থেকে ডিসেম্বর ২০১০ পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে ৩৪টি যন্ত্রপাতি দেওয়া হয়। দ্বিতীয় পর্যায় ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৭৩টি যন্ত্রপাতি দেওয়া হয়। তৃতীয় পর্যায়ের মেয়াদ ২০২০ থেকে শুরু হয়ে ২০২৭ পর্যন্ত; কিন্তু এ সময়ে এখনো কোনো যন্ত্রপাতি সশস্ত্র বাহিনীকে দেওয়া হয়নি। কার্যক্রম চলমান আছে। একইভাবে ফায়ার সার্ভিসকে প্রথম পর্যায়ে কোনো কোনো যন্ত্রপাতি দেওয়া হয়নি। দ্বিতীয় পর্যায়ে ২৯টি যন্ত্রপাতি দেওয়া হয়। তৃতীয় পর্যায়ে তিনটি যন্ত্রপাতি দেওয়া হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে দেওয়া অনেক যন্ত্রপাতি পুরোনো ও মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের উপপরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) মো. মামুনুর রশিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পুরোনো হয়ে যাওয়ায় উদ্ধার যন্ত্রপাতির কিছু ব্যবহার অনুপযোগী, কিছু এখনো ব্যবহার হচ্ছে। কিছু যন্ত্রপাতি বৈদেশিক ক্রয়প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। এর একটি অংশ নষ্ট হলে বাইরে থেকে টেকনিশিয়ান এনে ঠিক করতে হয়। এ ধরনের কিছু যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেছে।
সশস্ত্র বাহিনীকে দুই পর্যায়ে ১০৩টি যন্ত্রপাতি দেওয়া হয়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের তথ্যে, ফায়ার সার্ভিসকে দুই মেয়াদে ২৯টি যন্ত্রপাতি দেওয়া হয়। তৃতীয় পর্যায়ে ফায়ার সার্ভিসকে দুটি ৬৪ মিটারের এরিয়াল প্ল্যাটফর্ম ল্যাডার, চারটি ৫৪ মিটারের এরিয়াল প্ল্যাটফর্ম ল্যাডার এবং পাঁচটি ৩৮ মিটারের এরিয়াল প্ল্যাটফর্ম ল্যাডার দেওয়া হয়। এ ছাড়া তৃতীয় পর্যায়ে ফায়ার সার্ভিসের জন্য ফায়ার রেসকিউ টেন্ডার, ফোর হুইলার ওয়াটার মিস্ট, ভাইব্রাসকোপ, লাইফ ডিটেক্টরসহ আরও কিছু যন্ত্রপাতি ক্রয়প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে।
তথ্য বলছে, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের জন্য আরও কেনা হচ্ছে ৩৫ টনের হেভি ক্রেন, ১৫ টনের ফোর্ক লিফট, ২০ টনের ডোজার, ৪৮ টনের ডোজার, ২০ টনের ক্রেন লাইট ইত্যাদি। পুলিশের জন্য কেনা হবে সাইট স্ক্যানার সোনার অপারেটিং মেশিন, ২০ টনের রেকার, লাইফ ডিটেকটর উইথ একুএসটিক অ্যান্ড ভাইব্রেটিং সেন্সর, অপটিক্যাল লাইফ ডিটেকটর, ইলেকট্রোম্যাগনেটিক লাইফ ডিটেকটর, মোবাইল ক্রেন ইত্যাদি। র্যাবের জন্য ট্যাকটিক্যাল থ্রো ওয়াল রাডার সিস্টেম, নাইট ভিশন গগলস উইথ হেডসেট ডুপ্লেক্স কমিউনিকেশন সিস্টেমস, হাউজ ব্রেকিং ইকুইপমেন্ট কেনা হবে।