উচ্চ সুদ আর কম ঋণই এখন অর্থনীতির সংকট। ব্যাংকিং খাতের এই দুই সংকট বিনিয়োগের গতি আরো মন্থর করে তুলছে। এই দুই সূচক উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ চক্র পুনরুদ্ধারের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন তথ্য প্রকাশ করেছে খোদ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ-জিইডি।
ওই বিভাগের নভেম্বর মাসের ইকোনমিক আপডেটে এ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনটি সোমবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধান উপদেষ্টার সামনে উপস্থাপন করা হয়।
ওই প্রতিবেদনে দেখানো হয়, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ দাঁড়িয়েছে ৬.২৯ শতাংশ, যা আগের মাসের ৬.৩৫ শতাংশ থেকে আরো কম। গত চার বছরে এটি সর্বনিম্ন স্তর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত ঋণ লক্ষ্যমাত্র ২০২৫ অর্থবছরের ৭.২ শতাংশের অনেক নিচে।
অর্থনীতিবিদদের ভাষায়, এই নিম্নমুখী প্রবাহের অর্থ দাঁড়ায়, বিনিয়োগ কার্যত ‘ডেড জোনে’।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের ব্যাংকিং খাতে উচ্চ সুদের ফাঁদও এখন একটি ‘স্ট্রাকচারাল ব্যারিয়ার’। ২০২৫ সালের সর্বশেষ ছয় মাসের তথ্য দেখায়, বিদেশি ব্যাংকগুলোর স্প্রেড সবচেয়ে বেশি, আগস্টে যা দাঁড়ায় ৯.২২%, সেপ্টেম্বরেও ছিল ৮.৯৮%। এমনকি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর স্প্রেডও এপ্রিলের ৫.৯৫% থেকে সেপ্টেম্বরে ৫.৭৪% নামলেও উচ্চই রয়ে গেছে।
প্রাইভেট ব্যাংকগুলো ছয় মাস ধরে ৫.৫৫% থেকে ৫.৬৮%, এই অস্বস্তিকর স্থিতিতে চলছে। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর স্প্রেড সবচেয়ে কম হলেও তাদের সক্ষমতা সীমিত।
এ ধরনের উচ্চ স্প্রেডের পেছনে রয়েছে অব্যবস্থাপিত খেলাপি ঋণ (এনপিএল), পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি এবং বাজারের অতিরিক্ত ঘনত্ব, যেখানে কার্যকর প্রতিযোগিতার ঘাটতি থাকায় সুদের হার কমার পরিবেশ তৈরি হয় না। ফলে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত পিছিয়ে দিচ্ছেন, উৎপাদন সম্প্রসারণের পরিকল্পনাও থমকে আছে।
অন্যদিকে ব্যাংকগুলোর আচরণে এসেছে অতিরিক্ত সতর্কতা।
উচ্চ খেলাপি ঋণের ঝুঁকিতে অনেক ব্যাংক এখন কম ঝুঁকিপূর্ণ সরকারি ঋণের দিকে বেশি ঝুঁকছে। ফলে সেপ্টেম্বর মাসে সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ দাঁড়িয়েছে ২৪.৪৫ শতাংশ, যা বেসরকারি খাতের বিপরীতে এক অসম চাপ তৈরি করছে। এ অবস্থাকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন ‘ক্রাউডিং আউট’, যেখানে সরকারের অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণের কারণে বেসরকারি খাতের জন্য অর্থায়নের জায়গা সংকুচিত হয়।
ব্যাংকিং খাতের এ সংকট সরাসরি মুদ্রানীতির লক্ষ্যকেও ব্যাহত করছে। উচ্চ সুদ, সীমিত ঋণ এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে ব্যবসায়ীরা নতুন যন্ত্রপাতি আমদানিও কমিয়ে দিয়েছেন। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, জুলাইয়ে ৪৫৫.৯৩ মিলিয়ন ডলার থেকে কমে হয়েছে ২৬৭.১ মিলিয়ন ডলার। যদিও আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে সামান্য স্থিতি দেখা গেছে, তবে এটি সংকট কাটছে এমন কোনো নির্দেশনা দেয় না।
এর ফলে অর্থনীতির বিনিয়োগ চক্রে গভীর প্রভাব পড়ছে। নতুন প্রকল্প কমে যাচ্ছে, কর্মসংস্থান কমছে এবং উৎপাদন সম্প্রসারণ থমকে আছে। অর্থনীতির এই স্থবিরতা এমন সময় দেখা দিচ্ছে, যখন সরকার উন্নয়ন ব্যয়ও কম করেছে এবং স্থানীয় রাজস্ব সংগ্রহ টার্গেটের ২২.৬৩ শতাংশ পিছিয়ে রয়েছে।
অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিস্থিতিতে প্রধান দৃষ্টি দিতে হবে ব্যাংকিং খাতে সুদ-স্প্রেড কমানো, খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনা জোরদার করা এবং বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ পুনরুদ্ধারের দিকে। অন্যথায়, মুদ্রাস্ফীতি কমলেও উৎপাদন ও বিনিয়োগে যে স্থবিরতা দেখা দিচ্ছে, তা সামগ্রিক অর্থনীতিকে দীর্ঘ মেয়াদে ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিতে পারে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন খুঁড়িয়ে চলছে। সবখানেই হতাশার ছাপ। বেসরকারি খাতে ঋণ যাচ্ছে না, বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলো বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছে। এ রকম অনিশ্চয়তায় কেউ বিনিয়োগ করতে চায় না। সুদহার যত বাড়ছে, ততই বিনিয়োগের আগ্রহ কমছে। এতে শুধু উদ্যোক্তারা নন, পুরো অর্থনীতিই চাপে পড়ছে। কৃষি, এসএমই ও স্বাস্থ্যসেবায় কম সুদে ঋণ নিশ্চিত করা গেলে প্রবৃদ্ধি আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে।