ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জনমত গঠনের পাশাপাশি বিরোধী দলের সমালোচনার জবাব ও সংস্কারের অঙ্গীকার নিয়ে ভোটারদের আশ্বস্ত করতে প্রচারাভিযান গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি। সংশ্লিষ্টরা জানান জেলা-উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে বৈঠক, সমাবেশ ও আলোচনার মাধ্যমে এ প্রচারণা চালানো হচ্ছে। পাশাপাশি প্রতিটি কর্মসূচিতে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জন্য দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠান থাকবে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রচারে নতুন মাত্রা যোগ করেছে বিএনপি। মাঠের পাশাপাশি ডিজিটাল দুনিয়াতেও সমানভাবে সক্রিয় হতে চায়। সে লক্ষ্যেই গঠন করা হচ্ছে নতুন একটি অনলাইন ও তৃণমূলভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম ‘বাংলাদেশ গ্রাসরুটস নেটওয়ার্ক’ (বিজিএন)। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিএনপি তাদের তৃণমূলের শক্তিকে সুসংগঠিত করবে এবং অনলাইন প্রচারকে আরও জোরদার করবে। একই সঙ্গে অপপ্রচার মোকাবিলায় কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলাই এর অন্যতম উদ্দেশ্য। বিজিএন গঠনের প্রস্তাব এরই মধ্যে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনার পর অনুমোদিত হয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার ১৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃত্ব দেবেন। প্রত্যেক কেন্দ্রীয় নেতা ২০টি আসনের সমন্বয় করবেন। বিজিএনের অধীনে দেশের ৩০০টি সংসদীয় আসনে দুজন করে মোট ৬০০ জন স্নাতক পাস অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নিয়োগ দেওয়া হবে। এই অ্যাক্টিভিস্টরা সরাসরি তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করবেন এবং নিয়মিত কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন। তাদের প্রতি মাসে নির্দিষ্ট হারে সম্মানি দেওয়া হবে। বিজিএন স্থায়ী কমিটিতে নিয়মিত রিপোর্ট জমা দেবে, যা দলের নীতিনির্ধারণী আলোচনায় ব্যবহৃত হবে। বিএনপির মিডিয়া সেল বর্তমানে অনলাইন প্রচারে বিশেষভাবে সক্রিয়। ফেসবুক, ইউটিউব, এক্স (সাবেক টুইটার), টিকটক ও ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে তাদের শক্তিশালী উপস্থিতি আছে। বিএনপি মিডিয়া সেলের ফেসবুক পেজে ৩৩ লাখের বেশি অনুসারী রয়েছে, আর ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’ পেজে অনুসারীর সংখ্যা ৩৮ লাখেরও বেশি। ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইবার ৩৮ হাজারের বেশি এবং এক্স-এ অনুসারী প্রায় ১ লাখ। সরকার পরিবর্তনের পর এক্সে দলের অনুসারীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। পাশাপাশি, টিকটক ও ইনস্টাগ্রামেও দলের তরুণ কর্মীদের কার্যক্রম চোখে পড়ার মতো। এদিকে নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি ও দলটির এক সময়ের মিত্র জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে বাগ্যুদ্ধ ও তিক্ততা বেড়েই চলেছে। দুই দলই একে অন্যের বিরুদ্ধে ‘আওয়ামী লীগের ভাষায়’ কথা বলার অভিযোগ করছে, যা রাজনৈতিক মহলে কৌতূহল তৈরি করেছে। সাম্প্রতিককালে দল দুটির কেন্দ্রীয় নেতারা সভা-সমাবেশে পরস্পরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি নানা ধরনের বক্তব্য দিয়ে সংবাদ মাধ্যমে আলোচনায় আসছিলেন। তবে এটি ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে দুই দলের দুই শীর্ষ নেতাও সেই ধারায় বক্তব্য রাখার পর। শনিবার সিলেটে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বিএনপিকে ইঙ্গিত করে বক্তব্য দেওয়ার পর রবিবার ভার্চুয়াল এক বক্তব্যে তার পাল্টা জবাব দিয়েছেন রাজনৈতিক আশ্রয়ে লন্ডনে অবস্থান করা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
এদিকে বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের পরস্পরকে সমালোচনা করে দেওয়া বক্তব্যের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে উভয় দলের কর্মী ও সমর্থকদেরও। নিজ দলের প্রশংসা ও প্রতিপক্ষ দলকে ইঙ্গিত করে সমালোচনামূলক নানা পোস্ট করতে দেখা যাচ্ছে তাদের। দল দুটির মধ্যে তিক্ততা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে পাবনা, চট্টগ্রাম, ঝিনাইদহ, চাঁদপুর, রাজশাহী ও নরসিংদীসহ দেশের কোনো কোনো জায়গায় তা সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে।
পরস্পরবিরোধী বাহাস কিংবা তিক্ততার বিষয়ে জানতে চাইলে, দুই দলের নেতারাই এ জন্য একে অন্যকে দায়ী করে রাজনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলছেন, আমরা যা বলছি তা ইতিহাসভিত্তিক ও সত্যি তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। অন্যদিকে জামায়াত বলছে, বিএনপির দিক থেকে কিছু আক্রমণাত্মক বক্তব্য আসছে যা অপ্রত্যাশিত।
সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বড় পরিসরে প্রচারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে সেক্টরভিত্তিক অঙ্গীকার নিয়ে শিগগিরই মাঠে নামছে দলটি। এ জন্য কেন্দ্রীয় ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সমন্বয়ে আসনভিত্তিক টিম গঠন করা হচ্ছে। রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে কী বাস্তবায়ন করতে চায়, কী পরিবর্তন আনবে, দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পৃথক লিফলেটের মাধ্যমে জনগণের সামনে তুলে ধরবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন নীতিনির্ধারক বলেন, আগামী দিনে রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে দেশ পুনর্গঠনে প্রতিটি সেক্টরে কর্মপরিকল্পনা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরবে বিএনপি। মোটাদাগে লিফলেটে দেশের উন্নয়নে বিএনপির কর্মপরিকল্পনা, নাগরিকদের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কী কী পদক্ষেপ নেবে, রাষ্ট্র মেরামতে ৩১ দফাসহ নানা প্রতিশ্রুতি তুলে ধরা হবে। যেমন শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য খাত, কৃষি ও খাদ্য, শিল্প খাত, ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্রীড়া, প্রশাসন, দুর্নীতি প্রতিরোধসহ প্রতিটি সেক্টরকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা তুলে ধরে আলাদা লিফলেটের মাধ্যমে প্রচার করবে বিএনপি।
সূত্রমতে, এর মধ্য দিয়েই কেন্দ্রীয়ভাবে প্রচার ও গণসংযোগে নামার পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপির। এ ছাড়া প্রতিটি এলাকায় সুবিধা-অসুবিধা আর জনগণের চাওয়া-পাওয়াকে প্রাধান্য দেওয়া হবে লিফলেটে। তরুণ প্রজন্ম ও নারী ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য লিফলেটে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হবে। এসব লিফলেট দেশের প্রতিটি ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্যও নেতা-কর্মীদের প্রতি বিশেষ নির্দেশ থাকবে। বিশেষ করে নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি জনমত গঠনের পাশাপাশি বিরোধী দলের সমালোচনার কড়া জবাব দেবে।