২৯ নভেম্বর, ১৯৭১। তখনো ভোরের কুয়াশা কাটেনি। নদীবেষ্টিত চরাঞ্চল নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার বক্তাবলীর মানুষ ছিল ঘুমিয়ে। দেশ যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, ঠিক তখনই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায় বক্তাবলী পরগনার ২২টি গ্রামে। গ্রামগুলো থেকে নিরীহ ১৩৯ জনকে ধরে এনে নদীর পারে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। অনেক লাশ পাশের লক্ষ্মীনগর গ্রামে স্তূপ করে রাখা হয়। কারও কারও লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয় নদীতে। ২২ গ্রামের বাড়িঘর গানপাউডার দিয়ে পুড়িয়ে দেয় হানাদার বাহিনী। তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি নারী কিংবা শিশু। স্বাধীনতাযুদ্ধে নারায়ণগঞ্জে একসঙ্গে এত মানুষ হত্যার ঘটনা দ্বিতীয়টি নেই।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক রায়হান কবির জানান, প্রতি বছরই প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ দিন পুষ্পস্তবক অর্পণ, দোয়ার আয়োজনসহ নানান কর্মসূচি পালন করা হয়। শহীদ পরিবারের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কাগজপত্র দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পঞ্চবটিতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) নিয়ন্ত্রণাধীন যমুনা অয়েল ডিপোতে (তৎকালীন ন্যাশনাল অয়েল মিল) পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের এনে হত্যা করে। নির্যাতনের পর হাত-পা বেঁধে তাদের বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দিত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মিলের ভিতর থেকে নারীদের নির্যাতনের বহু আলামত পাওয়া গেছে। পরে সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল ভোরে বন্দর উপজেলার সিরাজদ্দৌলাহ ক্লাব মাঠে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ৫৪ নারী-পুরুষকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। পরে লাশগুলো গানপাউডার দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। সদর উপজেলার সিদ্ধিরগঞ্জের বিলুপ্ত আদমজী জুট মিলের বিহারি ক্যাম্প ‘যমঘর’ হিসেবে পরিচিত ছিল। যুদ্ধের পর এখান থেকে মানুষের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়।
ফতুল্লার পঞ্চবটি শাসনগাঁও মেথরখোলায় (বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ট্রাক টার্মিনাল) গণকবর রয়েছে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়কের পাশে পাগলার পাশের ইটখোলাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহার করত। এ বধ্যভূমি থেকে বেয়নেটের ১৮টি আঘাত নিয়ে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান আবদুল বারী নামে এক ব্যক্তি।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়কের আলীগঞ্জ সরকারি পাথর ডিপোর বধ্যভূমিতে বহু বাঙালিকে হত্যা করা হয়। ডিপোর এক বৃদ্ধ চৌকিদারের মতে শুধু এক দিনেই এখানে ৮০ জনকে হত্যা করা হয়। নারায়ণগঞ্জ শহরের বিআইডব্লিউটিএ ঘাট জেটিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী লোকজনকে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যায় ফেলে দিত।