আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের তিন দিন পর গত বছরের ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্র্বর্তী সরকার। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ছিল সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ। হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছিলেন তৎকালীন সরকারের মন্ত্রী এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা। তাই অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল একটি স্বচ্ছ ইমেজ প্রতিষ্ঠা। সরকারের ছাত্র উপদেষ্টা ছাড়া বাকি সবাই সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি। সুশীল সমাজের প্রতিনিধি। প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রথম ভাষণে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতার কথা বলেন। ক্ষমতা গ্রহণের দুই সপ্তাহের মাথায় ২৫ আগস্ট সন্ধ্যায় অধ্যাপক ইউনূস জাতির উদ্দেশে প্রথম যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেখানে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, শিগগিরই তাঁর উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা নিজেদের আয় ও সম্পদের বিবরণী জনগণের সামনে প্রকাশ করবেন। ‘বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করেছে। আমাদের সব উপদেষ্টা দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাদের সম্পদের বিবরণ প্রকাশ করবেন। পর্যায়ক্রমে এটি সব সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও নিয়মিত ও বাধ্যতামূলক করা হবে, ‘ভাষণে বলেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূস’। তাঁর ওই ভাষণের পর উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশে সরকার আলাদা করে একটি নীতিমালাও তৈরি করেছিল। কিন্তু অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠনের দেড় বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে, উপদেষ্টাদের কারও আয় ও সম্পদের হিসাব জনগণের সামনে প্রকাশ করা হয়নি। এর মধ্যেই উপদেষ্টা, তাদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের একের পর এক অভিযোগ উঠতে দেখা যাচ্ছে। যদিও উপদেষ্টারা অভিযোগগুলো অস্বীকার করেছেন। এ বছরের আগস্টে অন্তর্র্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন সাবেক সচিব এ বি এম আবদুস সাত্তার। তিনি এক বা দুটি মন্ত্রণালয়ের ইঙ্গিত দিলেও নির্দিষ্ট করে কোনো নাম উল্লেখ করেননি। তবে তার দাবির পক্ষে প্রমাণ আছে বলে তিনি জানিয়েছিলেন। তাঁর এই বক্তব্যের পর সর্বমহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা এবং বিতর্ক শুরু হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ বক্তব্যের আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানানো হয়। কিন্তু এ বক্তব্য অন্তর্র্বর্তী সরকারের ইমেজ কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ন করে। এ ছাড়াও দুজন ছাত্র উপদেষ্টাসহ কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ বছরজুড়েই আলোচিত ছিল। বিশেষ করে ছাত্র উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বারবার দুর্নীতির বিতর্কে জড়িয়েছেন। নিজ নির্বাচনি এলাকায় নিয়মবহির্ভূত ভাবে বরাদ্দ দেওয়া, বাবার নামে লাইসেন্স, ক্রিকেট বোর্ড এবং ক্রীড়া পরিষদের বিভিন্ন কেনাকাটা ও টেন্ডারে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে বারবার। যদিও এসব অভিযোগ সবসময় অস্বীকার করেছেন আসিফ মাহমুদ।
একাধিক উপদেষ্টার ব্যক্তিগত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয় বটে, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের তদন্তের কোনো অগ্রগতি নেই। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের ১৪ আগস্ট যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের এপিএস হিসেবে মোয়াজ্জেম হোসেনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তখন প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, আসিফ মাহমুদ যতদিন এ পদ অলংকৃত করবেন অথবা এপিএস পদে বহাল রাখার অভিপ্রায় পোষণ করবেন, ততদিন এ নিয়োগ আদেশ কার্যকর থাকবে।
এপিএস পদে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ উঠতে থাকে। অন্যদিকে গত বছরের ২ অক্টোবর তুহিন ফারাবীকে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁর বাড়ি নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী উপজেলায়। তাঁর নিয়োগের অফিস আদেশে বলা হয়েছিল, তুহিন ফারাবীর এ নিয়োগ হবে অস্থায়ী। উপদেষ্টা যতদিন এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবেন, অথবা যতদিন তাঁকে এ পদে রাখার ইচ্ছা পোষণ করবেন, ততদিন তিনি এ পদে বহাল থাকবেন। তাঁকে নিয়েও মন্ত্রণালয়ে নানা ধরনের অভিযোগ উঠেছে। তুহিন ফারাবী কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় মেডিকেল দলের সদস্য।
শতকোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মোয়াজ্জেম হোসেনকে তাঁর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। গত ২১ এপ্রিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়। এ ছাড়া স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগমের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মুহাম্মদ তুহিন ফারাবীকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। দুই উপদেষ্টার এপিএস ও পিও-এর বিরুদ্ধে বদলি-পদোন্নতির মাধ্যমে ঘুস বাণিজ্য, কেনাকাটায় কমিশন বাণিজ্য, পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেওয়াসহ দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ ওঠে। দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে দুদক। (বিএফআইইউ) মাধ্যমে তাদের বিভিন্ন ব্যাংকের হিসাববিবরণী সংগ্রহ করা হয়। এতে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়। তদন্তে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ার পর প্রকাশ্যে অনুসন্ধানের জন্য টিম গঠন করা হয় ৪ মে। আরও জানা যায়, পৃথক দুটি অনুসন্ধান টিম স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার সাবেক এপিএস মোয়াজ্জেম হোসেন ও স্বাস্থ্য উপদেষ্টার পিও তুহিন ফারাবীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে। এ ছাড়াও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সাবেক যুগ্ম সদস্যসচিব এ বি এম গাজী সালাউদ্দিন আহমেদ তানভীর ও ডা. মাহমুদুল হাসানকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়। তাদের ২০, ২১ ও ২২ মে হাজির হওয়ার জন্য নোটিস দেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। প্রথম দফায় তারা নির্ধারিত দিনে হাজির হননি। পরবর্তী ধার্য দিনে তারা একে একে সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হয়ে অনুসন্ধান টিমের কাছে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এর বাইরে এ সংক্রান্ত অনুসন্ধান কাজে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।
বাংলাদেশের মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদের’ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম এবং ১৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠার পর প্রধান উপদেষ্টার একজন বিশেষ সহকারীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও তার স্ত্রীকে দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদকে তলবের ঘটনা নানা আলোচনার জন্ম দেয়। সেই কর্মকর্তা আতিক মোর্শেদ দুদকে গিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন, তবে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে কি না তা নিশ্চিত করেনি দুদক। নগদ-এর নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ার কথা জানিয়েছিল দুদক। এ ছাড়া ১৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ যাচাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণসহ মি. মোর্শেদ ও তার স্ত্রীকে গত ২ জুন দুদকে ডাকা হয়েছিল। কিন্তু তারপর এই তদন্তেরও কোনো অগ্রগতি হয়নি।
প্রশ্ন উঠেছে, ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শতকোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার ঘটনাগুলোয় উপদেষ্টা কিংবা যার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে এসব ব্যক্তিরা কাজ করেছেন, তার দায় এড়ানোর সুযোগ আছে? এ ছাড়াও একজন উপদেষ্টার স্বামী আওয়ামী লীগের একজন পলাতক মন্ত্রীর সম্পদের মালিক হয়েছেন বলেও অভিযোগ করেছেন অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের। তার এই অভিযোগের জবাব অবশ্য ওই উপদেষ্টার পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি। এভাবেই গত দেড় বছরে উপদেষ্টা পরিষদের ইমেজ ক্ষুণ্ন হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্র্বর্তী সরকার দুর্নীতি কমালেও দুর্নীতির বৃত্ত থেকে পুরোপুরি বের হতে পারেনি।